বর্তমান বিশ্বে দুটি সামরিক সংঘাত অন্য সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী থেকে সবার নজর ও মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। না হলে এসব ঘটনা নিয়েই বেশি আলোচনা ও বিতর্ক হতো। এক যুগ পরে সিরিয়ার আরব লীগে ফিরে আসা ও দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে আরব নেতাদের উষ্ণভাবে গ্রহণ করা বর্তমান সময়ের ভূরাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ ও সুদানের গৃহযুদ্ধ এ বিষয়টিকে আড়ালে ঠেলে দিয়েছে। তবে সিরিয়াকে আরব লীগে ফিরিয়ে নেওয়াটা যে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে একটি ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে কাজ করবে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এর মাধ্যমে আরব লীগ এই স্বীকৃতিই দিয়েছে যে, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।
আরববিশ্বে ২০১১ সালে শুরু হওয়া সরকার বিরোধী আন্দোলন ‘আরব বসন্তের’ হাওয়া সিরিয়াতেও লাগে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া গণআন্দোলন গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। সিরিয়াকেও আরব লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর থেকে ২২ সদস্যের আরব লীগের সদস্য দেশগুলো বাশার বিরোধীদের সমর্থন দিয়েছেন। তারা এর মাধ্যমে বাশারের পতন ঘটাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইরান ও রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহায়তায় বাশার তার শত্রুদের পরাজিত করেছেন। ফলে তাকে ক্ষমতা থেকে সরানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে সাড়ে তিন লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়। কিন্তু এরপরও প্রেসিডেন্ট বাশার তার অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েননি।
এরপরই আরব নেতারা তাদের নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাশারের সাথে শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে তাকে আরব লীগে ফিরিয়ে এনেছেন। সৌদি আরবের জেদ্দায় গত মাসের ১৯ তারিখে অনুষ্ঠিত আরব লীগের শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট বাশারকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানানো হয়। বৈঠকের শুরুতে সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান বাশারকে আলিঙ্গন ও হ্যান্ডশেক করে শুভেচ্ছা জানান। সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমি আশা করছি, আরব লীগে ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সিরিয়ার সংকটের অবসান ঘটবে।
সিরিয়া ও প্রেসিডেন্ট বাশারের ব্যাপারে আরব নেতাদের মনোভাবের এই পরিবর্তন শুরু হয় এক বছর আগে থেকে। সিরিয়ার ব্যাপারে আরব লীগের অবস্থানের এই পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদেরা খুশি নয়। সিরিয়া ও প্রেসিডেন্ট বাশারের ব্যাপারে তারা কী নীতি গ্রহণ করবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল তাদের মধ্যে। তারা আরব লীগের পদাঙ্ক অনুসরণ করে সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করলে তা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠন কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। একইসাথে যুদ্ধের কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ সিরীয় শরণার্থীর দেশের ফেরার পথকেও সুগম করবে।
যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা সিরিয়া নিয়ে আরব দেশগুলোর পথে আসবে নাকি তা রুদ্ধ করবে তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে বলেছে, প্রেসিডেন্ট বাশারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগের নীতির কোনো পরিবর্তন হবে না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার কোনো চিন্তাই তারা করছে না।
সিরিয়া বিষয়ে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিক্রিয়া ছিল আরও বেশি কঠোর। কয়েকজন সদস্য কংগ্রেসে একটি বিল এনেছেন যাতে সিরিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ২০৩২ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর আহবান জানানো হয়েছে। বর্তমান নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ ২০২৫ সালে শেষ হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার কারণে কোনো দেশ সিরিয়ায় বিনিয়োগ করলে যুক্তরাষ্ট্র সেই দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ওয়াশিংটন বলছে, সিরিয়ার সংঘাতের একটি রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পথে হাঁটবে না যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এই মনোভাব সম্পর্কে সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান আল সৌদ বলেন, ‘আমরা যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে পারি। তবে সিরিয়া নিয়ে চলমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন উপায় প্রয়োজন এবং সংলাপ ছাড়া তা সম্ভব নয়। আমরা ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে তাদের উদ্বেগের উৎসগুলো নিয়ে আলোচনা করব।’
যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রেখেছে এবং দেশটির উত্তরাঞ্চলে ৯০০ মার্কিন সৈন্যের একটি বাহিনী মোতায়েন রাখা হয়েছে। আইএস জঙ্গিদের দমনের নামে এসব মার্কিন সেনা সিরিয়ার ওই এলাকায় কুর্দি বিদ্রোহীদেরকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিচ্ছে গত এক দশক ধরে। এই মার্কিন সেনাদের বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের তেল ও শস্য চুরি করে ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করে আসছে বাশার আল আসাদের সরকার।
সিরিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই নেতিবাচক নীতি সম্পর্কে মার্কিন কূটনীতিক উইলিয়াম রেয়েবাক কুইন্সি ইন্সটিটিউটের এক সেমিনারে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার ব্যাপারে ইউক্রেনের নীতিই অনুসরণ করতে চায়। এ কারণেই সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে চায় না তারা। এর কারণ হচ্ছে- বাইডেন প্রশাসন ইউক্রেনে পুতিন ও সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে বিজয়ী হতে দিতে চায় না।
ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সিরিয়া বিশেষজ্ঞ জোসুয়া ল্যান্ডিস মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও লক্ষ্য হচ্ছে সিরিয়ার পুনর্গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা। দেশটির বিদ্যুৎ লাইন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনর্নির্মাণে বিদেশি বিনিয়োগ যাতে সিরিয়ায় আসতে না পারে সেজন্যই দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা বলবত রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে বাশার আল আসাদের সরকারকে দুর্বল করে রাখা এবং সিরিয়ায় রাশিয়া ও ইরানের স্বার্থ হাসিলে বাধা দেওয়া। কিন্তু আরব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের এই উদ্যোগে যুক্ত থাকতে আগ্রহী নয়। সেজন্যই তারা সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে দেশটিকে ফিরিয়ে এনেছে আরব লীগে।
এক দশক আগে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সৌদি আরব ও আরব আমিরাতসহ এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশ প্রেসিডেন্ট বাশারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে বিরোধী জোটকে সমর্থন দেয়। কিন্তু এক দশক পর বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত বিশ্বাস করে, বাশার আল আসাদের সরকার আসলে মধ্যপ্রাচ্যের একটি বাস্তবতা। আর সিরিয়া এমন একটা দেশ, যেখানে তাদের প্রভাব থাকা দরকার। তাদের অনুপস্থিতিতে সিরিয়ায় শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে ইরান। তবে ইরানের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর সিরিয়াকে কাছে টানা সৌদি আরবের জন্য সহজ হয়ে যায়। সেজন্যই তারা এখন সিরিয়ার সাথে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চায়।
সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান সম্প্রতি তিনটি বড় ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এর প্রথমটি হলো- প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনের সাথে অস্ত্রবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর ও হুতি বিদ্রোহীদের সাথে আলোচনায় বসা। দ্বিতীয়টি হলো- ইরানের সাথে ৭ বছর পর সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা। তৃতীয়টি হচ্ছে- সিরিয়ার সাথে চলমান বিরোধ মিটিয়ে ফেলা।
সৌদি আরবের এসব সিদ্ধান্তে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে , তারা আর যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশনামতো চলতে ইচ্ছুক নয়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নিজেরাই স্বাধীনভাবে সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই তিনটি ক্ষেত্রে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সেই ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটেছে।
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ এখন অনেকটাই থেমে গেছে। এখন প্রতিবেশী দেশগুলো চায় সিরীয় শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে যাক। বিশেষ করে জর্ডান ও লেবানন সেই প্রত্যাশা থেকেই সিরিয়াকে আরব লীগে ফিরিয়ে আনার সৌদি উদ্যোগকে সমর্থন করেছে। কেননা এই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে গেলে জর্ডান ও লেবাননের মতো দরিদ্র দেশগুলো বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বোঝা বহন করা থেকে বেঁচে যাবে।
শরণার্থীরা দেশে ফিরে গিয়ে যেন কোনো ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার না হয় সেই নিশ্চয়তাও সিরিয়ার সরকারের কাছ থেকে পেতে চায় এসব দেশ। কিন্তু বাশার আল আসাদের সাথে সুসম্পর্ক না থাকলে সেই নিশ্চয়তা পাওয়া সম্ভব নয়। এছাড়া আরব দেশগুলো চায় সিরিয়ায় উৎপাদিত মাদক ক্যাপ্টাগনের ব্যবসা বন্ধে তিনি যেন পদক্ষেপ নেন। এই মাদকটি সিরিয়া থেকে লেবানন, জর্ডান ও সৌদি আরবসহ এই অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হচ্ছে।
সিরিয়ার ব্যাপারে আরব লীগ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও অনুসরণ করবেন কিনা সেটা এখন দেখার বিষয়। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলের কুর্দি বিদ্রোহীদের ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সেখানকার সীমান্ত এলাকায় সামরিক অভিযান চালিয়ে কিছু এলাকা দখল করেছেন। তুরস্কের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার শর্ত হিসেবে বাশার আল আসাদ সিরিয়ার সীমান্ত এলাকা থেকে তুর্কি সৈন্য প্রত্যাহার চান।
এরদোয়ান এখনই তা করতে চান না। সেনা প্রত্যাহারের আগে তিনি চান তুরস্কে সিরীয় কুর্দিদের হামলার স্থায়ী অবসান। সেটা হতে পারে কেবল কুর্দিদের কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দিয়ে তাদের সাথে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের একটি চুক্তি স্বাক্ষর। বাশার সেটা করবেন কিনা তার ওপরই সিরিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিষয়টি নির্ভর করছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।