গত এক দশক ধরে অনেক বিশ্লেষক বলে আসছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাক্স-পেটরা গুটিয়ে সরে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তির পক্ষে প্রমাণ দেওয়া হচ্ছে, ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়েছে ওয়াশিংটন। এছাড়া, মার্কিন বাজারে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির চাহিদাও আগের মতো নেই। কিন্তু এই বিশ্লেষণে সবকিছুকে যেন খুব বেশি সাদামাটাভাবে দেখা হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের ব্যপারে আমেরিকার যে সামগ্রিক কৌশল, তা শুধুমাত্র এখানে-সেখানে যুদ্ধ বা তেল বাণিজ্য দিয়ে বোঝা যাবে না। তাদের অবস্থানকে বুঝতে হবে সামগ্রিক নিরাপত্তা কাঠামোর ভিত্তিতে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার যত বয়ানই ছড়ানো হোক, বাস্তবতা হলো, তারা এই অঞ্চলে টিকে আছে অদম্য শক্তি হিসেবে। নেতৃত্বের যে আসনে তারা গেড়ে বসেছে, সেটাও ছেড়ে দেওয়ার কোনো আকাক্সক্ষা তাদের নেই। দৃশ্যমান এই নেতৃত্বের আসনে তারা আসীন হয়েছিল সেই ১৯৪৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বছরে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং সৌদি বাদশাহ আব্দুল আজিজ বিন সৌদের মধ্যে যে ঐতিহাসিক বৈঠক হয়েছিল, ওই বৈঠকই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বানিয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের নেতা। বৈঠকটি হয়েছিল সুয়েজ খালে ভাসমান আমেরিকান এক ক্রুজ জাহাজে বসে।
আরবদেরকে নিরাপত্তা, সন্ত্রাস দমন, আর পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আমেরিকা। প্রতিদানে তারা নিশ্চিত করেছিল, যাতে আমেরিকার দিকে তেলের প্রবাহ জারি থাকে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সব সময় অন্যান্য আরব দেশের উপর ইসরাইলের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রাধান্য দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এই ইহুদি রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্বকে টিকিয়ে রাখা ওয়াশিংটনের প্রধান এজেন্ডা হয়ে দাঁড়িয়েছে ওই অঞ্চলে।
১৯৮০ সালে যুক্তরাষ্ট্র যে কার্টার ডকট্রিন গ্রহণ করে, সেখানে শক্তি প্রয়োগের কথাও উল্লেখ আছে। দরকার হলে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শক্তি ব্যবহার করতে পারবে। এখান থেকেও বোঝা যায়, মার্কিন মহা-কৌশলের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থান কতটা গুরুত্বপূর্ণ।
কার্টার ডকট্রিনের প্রধান লক্ষ ছিল সোভিয়েত বিরোধী। উপসাগরীয় অঞ্চলে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাতে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, সে জন্যেই এই নীতি গ্রহণ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময়ে তাদের মধ্যে একটা উদ্বেগ কাজ করছিল। আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাকে পুঁজি করে সোভিয়েত ইউনিয়ন গুরুত্বপূর্ণ তেল সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, এ রকম আশঙ্কা ওয়াশিংটনকে পেয়ে বসেছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য ধরে রাখতে সামরিক শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কখনও দ্বিধা করেনি যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯০-৯১ সালে তারা জড়িয়েছে উপসাগরীয় যুদ্ধে। ২০০১ সালে আফগানিস্তানে চালিয়েছে আগ্রাসন। ২০০৩ সালে আগ্রাসন চালিয়েছে ইরাকে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের এই সব অন্ধকার অধ্যায় এখন সবারই জানা।
এই তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য সামরিক হস্তক্ষেপের আছে বিশেষ প্রেক্ষাপট। বিশ্ব ওই সময় মোটামুটি হয়ে উঠেছিল একমেরুকেন্দ্রিক। বৈশ্বিক একক আধিপত্য ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। পররাষ্ট্রনীতিতে তখন তথাকথিত উদারতান্ত্রিক হস্তক্ষেপের নীতি গ্রহণ করেছিল ওয়াশিংটন। এই সময় যুক্তরাষ্ট্র খুবই ঘন ঘন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আগ বাড়িয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। বিভিন্ন রাষ্ট্রকে গুন্ডা আখ্যা দিয়ে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের নামে নাক গলানো হয়েছে ওই সব দেশে ।
আজকের প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। ইতি ঘটেছে শীতল যুদ্ধকালীন দুই মেরুর বিশ্বের। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা শেষ হয়ে গেছে বলে ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা যে ধারণা তুলে ধরেছিলেন, সেটার বাস্তবতাও হয়ে আসছে ক্ষীণ। চীন এখন বিশ্বমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে উদীয়মান শক্তি হিসেবে। এই অবস্থায় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ঝুঁকছে বহুমেরুর বাস্তবতার দিকে। এই পরিস্থিতি বিশ্বকে একটা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে এনে দাঁড় করিয়েছে। অন্য সবার মতো ওয়াশিংটনকেও অবশ্যই পা ফেলতে হচ্ছে সতর্কভাবে ।
কিছু বিশ্লেষক বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমেরিকার সরে যাওয়ার যে বয়ান ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা ওয়াশিংটনের জন্য একটা কৌশলগত সুযোগ নিয়ে এসেছে। তাদের উচিত হবে, মধ্যপ্রাচ্যে অন্যান্য দেশের আচরণকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা। বিশেষ করে, আমেরিকার দৃশ্যমান অনুপস্থিতিতে চীনের মতো দেশগুলো সেখানে কি আচরণ করছে, সেটা পর্যবেক্ষণের সুযোগ এসেছে।
এই মুহূর্তে চীন কাজে লাগাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিরাপত্তা কাঠামোর সুযোগকে। এই অঞ্চলে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র বিনিয়োগের মধ্যেই তারা খুশি আছে বলে মনে হচ্ছে। তাদের যে উচ্চাকাক্সক্ষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্প আছে, চেষ্টা চলছে মধ্যপ্রাচ্যেও তার সম্প্রসারণের।
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্র খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, চীনের সশস্ত্র বাহিনীর সামরিক সক্ষমতা আসলেই কতখানি। মধ্যপ্রাচ্যে বেইজিংয়ের উদ্দেশ্য খতিয়ে দেখার পাশাপাশি এই অনুসন্ধানও তারা চালাচ্ছে।
চীনের নেতাদের তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের বলয় থেকে বের হওয়ার খুব একটা ইচ্ছা নেই। অন্যদিকে, আমেরিকার কর্তা-ব্যক্তিরা জানতে চান, বেইজিংয়ের আসল উদ্দেশ্য কি। তাদের সক্ষমতাই বা কতটুকু। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির জটিল জগতে যদি তাদেরকে চীনের মুখোমুখি হতে হয়, তাহলে বেইজিং কতটা সক্ষমতা দেখাতে পারবে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়ার বয়ানটি বেশ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। অনেকে এতে হয়েছেন কৌশলগতভাবে লাভবান। কিন্তু মাঠের বাস্তবতা যাচাই করলে এই বয়ানের সত্যতা মেলে না। অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি ধরা যেতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সারা বিশ্ব যে পরিমাণ অস্ত্র বিক্রি করছে, তার ৫৪ শতাংশই করছে যুক্তরাষ্ট্র। এককভাবে সৌদি আরবের কথা ধরলে, তাদের অস্ত্রের ৭৮ শতাংশই আসছে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে।
কোন দেশ যদি একবার যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সরঞ্জামের ক্রেতা হয়, তাহলে তাদের পক্ষে দ্বিতীয় কারও কাছ থেকে অস্ত্র কেনাটা মারাত্মক জটিল হয়ে ওঠে। প্রযুক্তি, অস্ত্র সরঞ্জামের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ - এই সব বিবেচনা থেকে সেটা খুব একটা বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠে না। ওয়াশিংটনও এটা বোঝে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো মাঝে মধ্যে অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র সরঞ্জাম কিনলেও, যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোকে তাই বড় কোন হুমকি হিসেবে দেখে না।
মধ্যপ্রাচ্যে নজরদারির একটা মেকানিজম গড়ে তুলেছে ওয়াশিংটন। এই অঞ্চলের যারা গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়, তাদের কর্মকাণ্ডের ওপর তারা গভীর নজর রাখে। এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু গোয়েন্দা দলিলপত্র ফাঁস হয়েছে। এই সব দলিলপত্রেও মধপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের উপর নজরদারির প্রমাণ রয়েছে। ফাঁস হওয়া একটি দলিলে রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সহযোগিতার সম্পর্কের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। দলিলে দাবি করা হয়েছে, আমিরাতের সাথে সম্পর্ক নিয়ে রাশিয়া গর্ব করেছে। এবং বলেছে, এই সহযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমাবে। আমিরাতের কর্মকর্তারা অবশ্য এ ধরনের দাবি নাকচ করেছেন। অন্যদিকে, ওয়াশিংটন ইচ্ছা করেই বিষয়টিকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছে।
এটা সত্যি যে, নাইন ইলেভেনের পরবর্তীকালে মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা আগের মতো শক্তি খাটাতে পারেনি। কিন্তু এটা বলা যাবে না যে, তারা দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে গেছে।
বাস্তবতা হলো, মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। সর্বোচ্চ এটুকু বলা যেতে পারে, এর ধরন বদলে গেছে। বদলে যাচ্ছে এই অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তার মানচিত্র। চীনসহ অনেক দেশের লেনদেন বেড়েছে এখানে। সামনে এসেছে একটা বহুমেরুর বিশ্বের ধারণা। পরিবর্তিত এই বিশ্ব ব্যবস্থার স্বরূপ কেমন হতে পারে, সেটা যাচাইয়ের একটা সুযোগ এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে।
মধ্যপ্রাচ্যের নিরাপত্তা ইস্যুতে এখনও প্রধান পক্ষ হলো যুক্তরাষ্ট্র। ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিদাতা হলো ওয়াশিংটন। উপসাগরীয় অঞ্চলে যে সব রাজতন্ত্র আছে, তাদেরও সুরক্ষা দিচ্ছে মার্কিনিরা। সার্বিকভাবে এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ধরে রাখার পেছনেও তাই ওয়াশিংটনের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তবে, বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে আমেরিকার যে সব আচরণ সহ্য করতে হচ্ছে, তারা যদি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে তাহলে অনেক কিছু বদলে যাবে। ওয়াশিংটনের প্রতিপক্ষ দেশগুলোর সাথে যদি মধ্যপ্রাচ্যর দেশগুলোর গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় বেড়ে যায়, অস্ত্র কেনার উৎস যদি বড় মাত্রায় বদলে যায় তাহলে পরিস্থিতি বদলে যাবে।
এই অঞ্চলের বর্তমান স্থিতিশীলতা যদি হুমকির মুখে পড়ে যায়, তাহলে বলতে হবে যে, আমেরিকান কর্তৃত্ব সেখানে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছে। আর ওয়াশিংটন যখন সেটা বুঝতে পারবে, তখন সেটা তারা অত সহজে মেনে নেবে না। বরং নতুন শক্তি নিয়ে তারা হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারে আরও সক্রিয় হবে।