তেলের দাম ধরে রাখতে একদিকে সৌদি আরব উৎপাদন কমিয়ে এনেছে। অন্যদিকে, ইউক্রেন যুদ্ধের খরচ জোগাতে তেলের প্রবাহ ধরে রাখার চেষ্টা করছে রাশিয়া। মাঝখান দিয়ে বাজার জয় করে নিচ্ছে তৃতীয় আরেকটি দেশ- সংযুক্ত আরব আমিরাত। জ্বালানি নীতি ঠিক করতে জুনে বৈঠকে বসেছিল সৌদি নেতৃত্বাধীন ওপেক আর রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন ওপেক-প্লাস। দীর্ঘদিন ধরে তেল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়াতে চেয়েছিল আমিরাত। এই বৈঠকে তারা সেই অনুমোদন নিয়েছে। তেলের দাম ধরে রাখতে সৌদি আরব যখন উৎপাদন কাটছাট করছে, তখন উৎপাদন বাড়িয়ে বাজারে জায়গা করে নিচ্ছে আমিরাত। এটা নিয়ে এককালের মিত্র দুই দেশের মধ্যে বাড়ছে দূরত্ব।
ওপেক প্লাসের বৈঠকে অনুমোদনের ভিত্তিতে ২০২৪ সালে প্রতি দিন দুই লাখ ব্যারেল পর্যন্ত উৎপাদন বাড়াতে পারবে আমিরাত। সব মিলিয়ে তাদের উৎপাদন দাঁড়াবে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন ব্যারেল। আমিরাত এমন সময় সুবিধা পাচ্ছে, যখন গ্রীষ্মে তেলের দাম দারুণভাবে ফিরে এসেছে। আন্তর্জাতিক বেঞ্চমার্ক ব্রেন্ট ক্রুড বেশ স্বাভাবিকভাবেই ব্যারেল প্রতি তেলের গতানুগতিক দাম ৮০ ডলারের সীমানা পার হয়ে গেছে।
জ্বালানি কনসাল্টিং ফার্ম ট্রান্সভার্সাল কনসাল্টিংয়ের প্রতিষ্ঠাতা এলেন ওয়াল্ড বলেছেন, আমিরাতের উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়টি কেউ তেমন খেয়াল করেনি। কিন্তু এটা তাদের একটা বড় জয়। তিনি বলেন, ওপেক-প্লাসের সব সদস্যের মধ্যে আমিরাত নিজেদেরকে বেশ সুবিধার জায়গায় নিয়ে গেছে।
ওই বৈঠকে আমিরাত উৎপাদন কমাতে রাজি হয়নি। যদিও অপরিশোধিত তেলের দামে গতি আনতে উৎপাদন কমায় সৌদি আরব। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সৌদি আরব সরবরাহ আরও কমিয়েছে। সেপ্টেম্বরে প্রতি দিন এক মিলিয়ন ব্যারেল উৎপাদন কমাবে দেশটি।
জ্বালানি কনসাল্টিং ফার্ম কেপলারের তেল বিশ্লেষণ বিভাগের প্রধান ভিক্টর কাটোনা বলেছেন, সৌদি আরব বিপুল উৎপাদন কমাচ্ছে। রাশিয়া মুখে বলেছে, তারাও উৎপাদন কমাচ্ছে। অন্যদিকে, আমিরাত কমিয়েছে একেবারেই সামান্য। ফলাফল হলো, কাজগুলো করছে সৌদি আরব, আর ফল পাচ্ছে আরব আমিরাত। এক মাস আগের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি তেলের দাম পাচ্ছে দেশটি। নিঃসন্দেহে তারাই লাভবান হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
দাম বাড়ানোর জন্য উৎপাদন কমানোর বোঝা সহ্য করছে সৌদি আরব। কারণ, রাশিয়া এশিয়াতে অপরিশোধিত তেল রফতানি অনেক বাড়িয়েছে। আমিরাতের নিরব মুনাফা অর্জনের কারণে আরেকটি চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে সৌদি আরবের সামনে। এক সময়ের মিত্র ধীরে ধীরে হয়ে উঠছে তাদের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিযোগী।
মধ্যপ্রাচ্যে কন্টকাকীর্ণ পররাষ্ট্রনীতির ইস্যুতে সৌদি আরব আর আমিরাত দীর্ঘদিন একসাথেই ছিল। এক দশক আগে যখন আরব বসন্ত এলো, তখন এই দুই মার্কিন অংশীদার এক হয়ে বিক্ষোভ আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। নিজেদের শাসনের জন্য এই আন্দোলনকে তারা হুমকি মনে করেছিল। এক হয়ে তারা প্রতিবেশী কাতারের বিরুদ্ধে আরোপ করেছিল অবরোধ, লিবিয়ায় জেনারেল খলিফা হাফতারকে দিয়েছিল সমর্থন, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য মিলিশিয়াদের সমর্থন দিয়েছিল। দুই দেশই ইরান সমর্থিত বিদোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ইয়েমেনে সেনা পাঠিয়েছিল।
দুই দেশের নেতা সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান আর আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের মধ্যে এখন বাড়ছে দূরত্ব। ডিসেম্বরে ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সৌদি ক্রাউন প্রিন্স আমিরাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুমকিও নাকি দিয়েছেন।
আমিরাত ২০১৯ সালে ইয়েমেনের যুদ্ধ থেকে সরে আসে। কিন্তু ইয়েমেনের দক্ষিণে বিচ্ছিন্নতাবাদী একটি গোষ্ঠিকে তারা দিয়ে গেছে পৃষ্ঠপোষকতা। এই গোষ্ঠি লড়ছে সৌদি সমর্থিত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ইয়েমেন সরকারের বিরুদ্ধে। ওয়াশিংটন ডিসির সেন্টার ফর দ্য ন্যাশনাল ইন্টারেস্টের সিনিয়র ফেলো গ্রেগ প্রিডি বলেন, আমিরাত ও সৌদি আরবের মধ্যে যেসব বিষয়ে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, ইয়েমেন সেখানে একটি মাত্র ইস্যু।
তেল নীতি নিয়ে রিয়াদ আর আবুধাবির যে মতপার্থক্য, সেটা প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২১ সালে। আবুধাবি তেলের মূল্য কম ধরে উৎপাদন হিসাব করছে, এ রকম অভিযোগের কারণে আমিরাত তখন ওপেক-প্লাসের বৈঠক স্থগিত রেখেছিল।
সৌদি আরবের মতো আমিরাতও তেল শিল্পে করেছে বিপুল বিনিয়োগ। ২০২৭ সালের মধ্যে তারা তেল উৎপাদনের ক্ষমতা ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ব্যারেল থেকে ৫ মিলিয়ন ব্যারেলে নিয়ে যেতে চায়। কিন্তু সৌদি আরব সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করতে চায় যাতে তেলের দাম বাড়ে। তেল থেকে অর্জিত রাজস্ব তারা নিওম ও লোহিত সাগরে দ্বীপ উন্নয়ন প্রকল্পে কাজে লাগাতে চায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর থেকে নির্ভরতা কমানোর জন্যই এই পরিকল্পনা নিয়েছে রিয়াদ। অন্যদিকে, আমিরাতের প্রাইভেট খাত আগে থেকেই উন্নত। চাহিদা বেশি থাকতে থাকতে তারা তেলের উৎপাদন বাড়িয়ে নিতে চায়।
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত আমিরাতের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ আল-ওতায়বা ২০২২ সালের মার্চে বলেছিলেন, আমিরাত তেলের উৎপাদন বাড়াতে চায়, এবং ওপেকে তারা এ জন্য চাপ দিবে। প্রিডি বলেন, মাথাপিছু আয়ের হিসেবে আমিরাত সৌদি আরবের চেয়ে ধনী। সে কারণে স্বল্পকালিন দাম নিয়ে সৌদি আরব বেশি উদ্বিগ্ন। কারণ সরকারের ব্যায় সেখানে বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশের ভেতরে ভিন্নমতকে কঠোর হাতে দমন করেছেন। তবে, বেশ কিছু সামাজিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। সৌদি আরবের তরুণেরা সেগুলোকে স্বাগত জানিয়েছে। সৌদি আরবের জনসংখ্যা আমিরাতের চেয়ে ১৮ গুণ বেশি। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স তাই তেলের দাম নিয়ে অনেক বেশি সাবধান।
সৌদি ক্রাউন প্রিন্সের মধ্যে একটা উদ্বেগ রয়েছে। তেলের দাম পড়ে গেলে জনগণ এমবিএসের উপর আস্থা হারাতে পারে। অন্যদিকে, আমিরাতের এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দুই দেশই এখন এই অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক নেতৃত্বের জন্য লড়ছে। ওপেক- প্লাস যেভাবে কাজ করছে, সেটা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য।
দুবাই-ভিত্তিক একজন জ্বালানি এক্সিকিউটিভ বলেছেন, আমিরাত ওপেককে তেলের বাজারের স্থিতিশীলতা রক্ষার নিয়ামক হিসেবে দেখে। সৌদি আরবের নীতির ব্যপারে তাদের আপত্তি আছে। এখানে মূল ব্যক্তি হলো আব্দুলআজিজ বিন সালমান।
সৌদি তেলমন্ত্রী আব্দুলাজিজ বিন সালমানের একটা যুদ্ধংদেহী ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে। বাজার বিশ্লেষকদেরকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, তেলের সরবরাহ কমিয়ে আনার ব্যপারে সৌদি আরবের সদিচ্ছা নিয়ে কারোর যদি সন্দেহ থাকে, তাহলে তারা হতাশ হবে।
অন্যদিকে, ৪০ বছর বয়সী আমিরাতের তেলমন্ত্রী সুহাইল আল-মাজরুয়ির নীতি সব দিক থেকেই তার চেয়ে আলাদা। ২০১৩ সালে মাজরুয়ি যখন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন, তখন অনেকেই তাকে পাত্তা দেয়নি। কিন্তু ওপেকের মধ্যে প্রভাব বিস্তারের ক্ষেত্রে তিনি বেশ কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছেন। তার দক্ষতার কারণেই গ্রীষ্মে উৎপাদন বাড়ানোর অনুমতি আদায় করতে পেরেছে আমিরাত।
আমিরাত ও সৌদি আরব দুটোই রাজতন্ত্র শাসিত এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতকে তারা সহ্য করে না। সে জন্য তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাও কঠোর। কিন্তু আমিরাত নিজেদেরকে ব্যবসার জন্য নিরপেক্ষ ও নিরাপদ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। নিজেদেরকে তারা অনির্ভরযোগ্য হিসেবে দেখাতে চায় না।
সৌদি আরবের সাথে আমিরাতের দূরত্ব তৈরির আরেকটি কারণ আছে। রাশিয়ার যে সব তেল ব্যবসায়ী নিষেধাজ্ঞা এড়ানোর চেষ্টা করছে, তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে আমিরাত। আমিরাতের ফুজাইরাহ বন্দর রাশিয়ার তেল পরিবহনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। রাশিয়ার তেল ব্যবসায়ীরাও দুবাইয়ে ভিড় করেছে। এতে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছে আমিরাতের। কিন্তু দুবাইয়ের অর্থনীতি এতে ফুলে-ফেপে উঠেছে।
আমিরাতের সাথে প্রতিযোগিতায় নেমে ব্যবসায়ীদের আকর্ষণের জন্য বেশ কিছু সামাজিক পুনর্গঠনের কাজ করছে সৌদি আরব। কিন্তু বিদেশীদের আগমণ সেখানে আশানুরূপ হয়নি। মানুষ সেখানে ব্যবসার জন্য যেতে চায় না, কারণ সেখানে তারা থাকতে চায় না। এদের মধ্যে রাশিয়ানরাও আছে। ভদকা না থাকলে রাশিয়ানরা সেখানে যাবে না। অথচ সৌদি আরবে মদ নিষিদ্ধ।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি ক্ষেত্রে সৌদি আরব আমিরাতের চেয়ে এগিয়ে গেছে। সেটা হলো সৌদি আরবের জাতীয় তেল কোম্পানি আরামকো। এই কোম্পানি ইউরোপ থেকে নিয়ে চীন পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে তেল শোধনাগার ও পেট্রোকেমিকেলের মতো তেলজাত পণ্য উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।
পরিশোধিত পলিমার এবং তেল ও গ্যাসজাত পণ্য বহু শিল্পে ব্যবহৃত হয়। সার থেকে নিয়ে প্লাস্টিক, কাপড়ের ডিটারজেন্ট, কাগজ ও কাপড় সব শিল্পেই এগুলি কাজে লাগে। ট্র্যাডিশনাল তেলের চাহিদা কমে গেলেও বিশ্বে পেট্রোকেমিকেলের চাহিদা জোরালোই থেকে যাবে। সৌদি আরব এই তেল ও গ্যাসজাত পণ্য উৎপাদনে ব্যাপক জোর দিয়েছে।
আমিরাতের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি অ্যাডনকও চেষ্টা করছে তাদের বৈশ্বিক প্রভাব বাড়ানোর। ইউরোপের কেমিক্যাল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কোভেস্ত্রো এবং ব্রাজিলের পেট্রোকেমিকেল কোম্পানি ব্রাসকেম কেনার জন্য তারা প্রস্তাব দিয়েছে। অ্যাডনক সম্প্রতি জানিয়েছে, আজারবাইজানের গ্যাস ফিল্ডের ৩০ শতাংশের শেয়ারও রয়েছে তাদের।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ওপেক-প্লাসের সিদ্ধান্ত থেকে আমিরাত যদিও এখন লাভবান হচ্ছে, কিন্তু সৌদি আরব আপাতত তাদের উৎপাদন বাড়াবে না। কারণ, এত কিছুর পরও জ্বালানি বাজারে সৌদির কর্তৃত্ব খর্ব হবে না। এছাড়া, রিয়াদ নিজেও ভবিষ্যতে উৎপাদন বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। ২০২৭ সালের মধ্যে প্রতি দিনের উৎপাদন তারা ১৩ মিলিয়ন ব্যারেলে নিয়ে যেতে চায়। সেটা হলে তেল বাজারে বিপুল প্রভাব থাকবে সৌদি আরবের। এক মুহূর্তের ঘোষণায় বাজার তেলে সয়লাব করে দিতে পারবে তারা। আরব আমিরাত দূরে থাক, যুক্তরাষ্ট্রেরও যা করার সামর্থ্য নেই।