ইসরায়েলিরা ৭৫ বছর ধরে যা কল্পনা করেনি, তা-ই হয়েছে। শুধু ইসরায়েলিরা কেন, বিশ্বের কে চিন্তা করেছে, ইসরায়েলি শক্ত সুরক্ষা-বলয় ভেদ করে তাদের ভূখণ্ডে ঢুকে হাজারো মানুষকে হত্যা করবে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস।
ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতার প্রতিবাদে এবং আল-আকসা মসজিদে অবমাননার প্রতিশোধ নিতে ৭ অক্টোবর সকালে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলে ঢুকে পড়েন হামাসের যোদ্ধারা। এরপর শুরু হয় দখলদার নির্মূল অভিযান। যারাই সামনে প্রতিহত করতে এসেছেন, তাদেরকেই হত্যা করা হয়েছে।
হামাস এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘আল-আকসা ফ্লাড’। অভিযান শুরুর পর তারা ফিলিস্তিনের অন্য প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোকে অভিযানে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। সঙ্গে সঙ্গে সাড়া দেয় ইসলামিক জিহাদসহ সব প্রতিরোধ সংগঠন। একইসঙ্গে হামাসের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে লেবাননের হিজবুল্লাহ প্রতিরোধ আন্দোলন।
আকস্মিকভাবে কেন এই ভয়াবহ পদক্ষেপ নিল হামাস? তাদের নেপথ্যে সহায়তা দিচ্ছে কারা? প্রশ্নগুলো বারবার উচ্চারিত হলেও এর পরিচ্ছন্ন উত্তর আপাতত কারও কাছে স্পষ্ট নয়।
দৃশ্যত, এই অভিযানের পেছনে বিপুল আয়োজন ছিল। দীর্ঘদিনের একটি পরিকল্পনা না হলে এত নিখুঁতভাবে ইসরায়েলের মতো এক অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যুহকে ফাঁকি দিয়ে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হতো না। তাহলে কি ইসরায়েলের চেয়েও আধুনিক গোয়েন্দা প্রযুক্তি এই অভিযানে কাজ করেছে? ইসরায়েলের গোয়েন্দা টুলসকে অকার্যকর করেই কি সেখানে খুব সহজে ঢুকে পড়েছেন হামাসের যোদ্ধারা।
এই ঘটনার পর খুব স্বাভাবিকভাবেই ইসরায়েলের গোয়েন্দা ব্যর্থতা আলোচনায় এসেছে। বিশাল শক্তি আর নজরদারি সরঞ্জাম থাকার পরও ইসরায়েলের গোয়েন্দারা কেন হামাসের অভিযানের বিষয়টি টের পেলেন না, তা নিয়ে দেশটিতে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, এই অভিযান ছিল তাদের গোয়েন্দাদের ধারণার বাইরে; আগাম কোনো তথ্যই ছিল না তাদের হাতে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত, বিশে^র বিভিন্ন দেশে দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা তৎপরতায় নিয়োজিত মোসাদ এবং ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সব ধরনের সম্মিলিত প্রচেষ্টাকে ফাঁকি দিয়ে হামাস কীভাবে এতবড় অভিযান শুরু করল, তা নিয়ে সরব হয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য, এই ব্যর্থতার মাশুল ইসরায়েলকে বহু বছর ধরে দিতে হবে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা ইসরায়েলকে বোকা বানানোর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি হস্তগত করেছেন, এই ঘটনা তারই প্রমাণ।
এ-পর্যন্ত যে-প্রতিরোধ সংগঠনগুলো ইসরায়েলের ভেতরে হামলায় সম্পৃক্ত হয়েছে, তার সবগুলোই ইরানি-মদতপুষ্ট। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, ইরানই কি এই ঘটনার নেপথ্য নায়ক?
এই প্রশ্নগুলো উসকে দিয়েছে আরও কিছু তথ্য। হামাসের মুখপাত্র গাজি হামাদের বরাতে বিবিসি জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলা পরিচালনায় ইরানের সহায়তা পেয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলনটি। ইরান অবশ্য এই অভিযানের সঙ্গে নিজের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছে। জাতিসংঘে ইরানি মিশনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘আমরা ফিলিস্তিনিদের অটুট সমর্থন দিয়ে সবসময় তাদের পাশে আছি। তবে ফিলিস্তিনিদের এই প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আমরা জড়িত নই; তারা নিজেরাই এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।’
ইরান অস্বীকার করলেও হামলার পেছনে তাদের উচ্ছাস অন্য বার্তা দিচ্ছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রায়িসি ফিলিস্তিনি সেনা ও ফিলিস্তিনের সব দলের জন্য এই ঘটনাকে ‘বিজয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির-আবদুল্লাহিয়ান রোববার টুইটে এই হামলাকে বছরের পর বছর ধরে চলা হত্যা ও অপরাধের বৈধ প্রতিক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করেছেন।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অভিযানে ইরানের সম্পৃক্ততার কথা সরাসরি না বললেও পরোক্ষভাবে সেই আভাসই দিয়েছেন। ব্লিঙ্কেন বলেছেন, ইরান ও হামাসের মধ্যে সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। প্রকৃতপক্ষে ইরানের কাছ থেকে বহু বছর ধরে পাওয়া সমর্থন ছাড়া হামাস এই অবস্থানে আসতে পারত না। ইসরায়েলে হামাসের এই সুনির্দিষ্ট হামলায় ইরানের জড়িত থাকার বিষয়ে তারা এখনও প্রত্যক্ষ কোনো প্রমাণ পাননি জানিয়ে ব্লিঙ্কেন বলেন, তবে বহু বছর ধরে হামাসের প্রতি ইরানের সমর্থনের বিষয়টি স্পষ্ট।
এমন এক সময় ইসরায়েলে হামাসের হামলা হলো, যখন সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা তুঙ্গে পৌঁছেছে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই সম্ভাবনার কথা স্পষ্ট করেছেন। সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের এই প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিনিময়ে তারা রিয়াদকে বেসামরিক পরমাণু প্রযুক্তি দিতেও সম্মত। এই প্রক্রিয়া যখন দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে, তখনই ইসরায়েলে হামলার ঘটনা ঘটল।
ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদির সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পেছনে অনেকগুলো অনুষঙ্গ জড়িত। এই পদক্ষেপ মূলত মধ্যপ্রাচ্যে চীনের প্রভাব বিস্তারকে প্রতিহত করার চেষ্টা। গত মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় ইরান ও সৌদি আরব কূটনৈতিক সম্পর্ক আবার চালু করতে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিল এই প্রক্রিয়া। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির হাওয়া বইতে শুরু করেছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় চীনা আধিপত্য সহ্য করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। রিয়াদে একের পর এক মার্কিন কর্মকর্তা আসতে থাকেন। দৃশ্যপট দ্রুত পাল্টে যায়। আধিপত্য তৈরির সব ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। এর প্রতিফলন সম্প্রতি দেখাও গেছে। সৌদি আরব ও ইরান পারস্পরিক দূতাবাস বিনিময় করলেও বিভিন্ন ইস্যুতে তাদের মধ্যে মতদ্বৈততা দেখা গেছে। মোহাম্মদ বিন সালমান বলেই ফেলেছেন, ইরানের পরমাণু সামর্থ্য থাকলে সৌদি আরবের কেন থাকবে না।
খেয়াল করলে দেখা যাবে, হামাসের এই অভিযানের ঘটনায় একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও তাদের মিত্ররা, অন্যদিকে চীন, রাশিয়া, ইরান ও তাদের মিত্ররা।
হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুরুর দুইদিন পর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ৯০ মিনিটের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। কিন্তু সেখানে যৌথ বিবৃতির বিষয়ে ঐকমত্য অর্জিত হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র হামাসকে কঠোরভাবে নিন্দা জানাতে পরিষদের ১৫ সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানায়। কিন্তু, রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সদস্যরা হামাসকে নিন্দার পরিবর্তে বিষয়টিকে আরও বড় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখার কথা বলেন। জাতিসংঘে রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, তিনি বৈঠকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতিতে গিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনায় যাওয়ার আহ্বান জানান।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব ওয়ার বলেছে, হামাসের এই অভিযানে রাশিয়ার অনেক লাভ আছে। রাশিয়া চাইবে ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশে^র নজর যেন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে ঘুরে যায়। লক্ষ্য হাসিলে রাশিয়া এরইমধ্যে তাদের প্রচার কৌশল ব্যবহার করতে শুরু করেছে। থিঙ্কট্যাঙ্কটি বলেছে, ইসরায়েলে হামলার জন্য পশ্চিমাদের দোষারোপ করেছে রাশিয়া। ক্রেমলিনের ভাষ্য হলো, পশ্চিমা বিশ^ মধ্যপ্রাচ্যের সংকট অবহেলা করে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার দিকেই বেশি ব্যস্ত ছিল।
রুশ সরকারের নিরাপত্তা পরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ বলেছেন, চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের ৫০ বছর পূর্তির সময়টাতে হামাসের এই হামলা অপ্রত্যাশিত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের এটা নিয়েই ব্যস্ত থাকা উচিত। কারণ, কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সংঘাতে মূল ভূমিকায় আছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল হামাস ও লেবাননভিত্তিক প্রতিরোধ আন্দোলন হিজবুল্লাহ-র প্রতিনিধিদের বরাতে জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলার পরিকল্পনা শুরু হয় চলতি বছরের আগস্টে। আর এতে পুরোপুরি সহায়তা করেছে ইরান। সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইসরায়েলে হামলা চালাতে আগস্ট থেকে হামাসের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেন ইরানের ইসলামিক বিপ্লবী গার্ডের কর্মকর্তারা। তারা আকাশ, নৌ ও স্থলে একইসঙ্গে ইসরায়েলে হামলার পরিকল্পনা সাজান। খবরে বলা হয়, হামলার পরিকল্পনায় বেশ কয়েকবার পরিবর্তন আনা হয়। নতুন পরিকল্পনা সাজানো, পুরোনো পরিকল্পনা বাতিলসহ নানান বিষয়ে আলোচনা করে বৈরুতে বিপ্লবী গার্ডের কর্মকর্তা এবং ইরান সমর্থিত চারটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা একাধিকবার বৈঠক করেন।
তবে রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলকে বোকা বানানোর পরিকল্পনা চলে এক বছর ধরে। এ-সময় হামাস দেখিয়েছে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নন। কয়েকমাস ধরে সাধারণ ইসরায়েলিদের মধ্যেও তারা এই ধারণা পোক্ত করেছেন। ইসরায়েল দৃঢ়ভাবে মনে করেছে, হামাস যুদ্ধে জড়াবে না। অভূতপূর্ব গোয়েন্দা কৌশলের কারণে হামাস এত বড় হামলা চালাতে সক্ষম হয় বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
হামাসের অভিযান ইস্যুতে চীনের ভূমিকায় হতাশ হয়েছে ইসরায়েল। তেলআবিব তাদের বন্ধু চীনের কাছ থেকে হামাসের বিরুদ্ধে কঠোর নিন্দা আশা করেছিল। বেইজিংয়ে ইসরায়েলি দূতাবাসের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, যখন মানুষ খুন হচ্ছে, রাস্তায় জবাই করা হচ্ছে, তখন দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আহ্বান জানানোর সময় নয়। এর আগে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সব পক্ষকে সংযমের আহ্বান জানিয়ে বলেছিল, সঙ্ঘাত থেকে বেরিয়ে আসার মৌলিক উপায় হলো, দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের বাস্তবায়ন এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
দৃশ্যপট বিবেচনায় এটি নিশ্চিত, হামাসের অভিযানে ইরান, চীন, রাশিয়া ও তাদের মিত্ররা অসন্তুষ্ট নয়। বৈশি^ক অস্থির ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুটি বলয়ের একটি হামাসের পক্ষে, অন্যটি ইসরায়েলের পক্ষে। যুক্তরাষ্ট্র এরইমধ্যে ইসরায়েলে অত্যাধুনিক বিমানবাহী রণতরী পাঠিয়ে দিয়েছে। ইসরায়েল বলছে, তারা গাজাকে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দেবে। সেখানে আর হামাসকে নেতৃত্বে দিতে দেওয়া হবে না। অনেকে আশঙ্কা করছেন, সময়টাকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন সহায়তায় গাজাকে ইসরায়েলের সঙ্গে সংযুক্ত করার চেষ্টাও করবে তেলআবিব। কিন্তু, হামাস এখানে একা নয়। তাদের সঙ্গে চীন, রাশিয়া, ইরান তো আছেই, প্রকাশ্যে হামাসের পক্ষে কথা বলেছে, সিরিয়া, কাতার, জর্ডান, কয়েত ও মরক্কোর মতো দেশ। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর সরকার কৌশলী হলেও তাদের জনগণের প্রায় শতভাই ফিলিস্তিনিদের পক্ষে।
বৃহত্তর অর্থে এই যুদ্ধে যে হামাস কিংবা ফিলিস্তিনিরা হারবেন না, তা জোর দিয়েই বলা যায়।