ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের কত বড় জয় হয়েছে, তা সাদা চোখে নির্ণয় করা হয়তো সহজ নয়। ঘটনাবলির সামান্য ভেতরে গেলেই স্পষ্ট হবে, এই যুদ্ধ কিংবা এই যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে হামাসের অর্জনটা আসলেই আকাশ হাতে পাওয়ার মতো।
হামাসের জয়ের ভিত রচিত হয়েছিল ৭ অক্টোবর। সেদিন ইসরায়েলের সব দম্ভ নাস্তানাবুদ করে দেশটির ভেতরে গিয়ে বিশাল টার্গেট কিলিং সম্পন্ন করে বীরদর্পে ফিরেছিলেন হামাসের যোদ্ধারা। এরপর ইসরায়েলের নির্বিচার বিমানহামলা এবং হত্যাকাণ্ড শুরু হয়। এ-পর্যন্ত শিশু, নারী, বৃদ্ধ মিলে প্রায় দেড় হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণহানি হয়েছে। এর মাধ্যমে বিশে^র কাছে একটি বার্তা স্পষ্ট হয়েছে, ইসরায়েল রাষ্ট্রটি আসলেই বর্বর। আন্তর্জাতিক মানবিক মানদণ্ডগুলো বেপরোয়াভাবে উপেক্ষা করে দেশটি সারাবিশে^র সহানুভূতি হারিয়েছে। অনেক দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, অনেকে ছিন্ন করার পথে। যুক্তরাষ্ট্র ও হাতেগোনা কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ইসরায়েলের পক্ষে কথা বললেও অনেক দেশই বলছে, হামাসের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। ফিলিস্তিনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে শ^াসরুদ্ধকর দখলদারির শিকার হয়েছেন। তারা তাদের ভূখণ্ড অবৈধ বসতিতে পরিণত এবং সহিংসতায় জর্জরিত হতে দেখেছেন। তাদের অর্থনীতি থমকে গেছে। তারা বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এবং তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাদের দুর্দশার রাজনৈতিক সমাধানের আশাও ধূলিসাৎ হয়েছে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস-ও হামাসের পক্ষেই কথা বলেছেন।
তুরস্ক, কাতার, ইরান, মালয়েশিয়া, সিরিয়া, আফগানিস্তান কিংবা লেবাননের মতো অনেক দেশ স্পষ্টভাবে বলেছে, হামাস তাদের স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। তারা ইসরায়েলকে সন্ত্রাসী আখ্যা দিয়ে গণহত্যার জন্য নেতানিয়াহু ও তার মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মুখোমুখি করার দাবি তুলেছেন। সেই দাবি দিনদিন জোরালো হচ্ছে।
হামাস সন্ত্রাসী সংগঠন নয়, বরং স্বাধীনতাকামী; তারা দশক দশক ধরে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছে, তা বিশে^র অনেকের কাছেই অস্পষ্ট ছিল। কিংবা, অনেকে জেনেই পশ্চিমাদের সমীহ করে হামাসের পক্ষে কথা বলতে সাহস পেতেন না। এখন এই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে বিশ^। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য চীন কিংবা রাশিয়া সেই বৈশি^ক ধারণায় অনেকটা শক্তি জুগিয়েছে। রাশিয়া একাধিকবার জাতিসংঘে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তুলেছে, যেখানে হামাসকে সন্ত্রাসী না বলায় যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দিয়েছে। এখন চীন ও রাশিয়া বলয়ের দেশগুলোর কাছ থেকে বড় আকারের সহানুভূতি পাচ্ছে হামাস, যেমনটা আগে কখনও পায়নি। তাছাড়া, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে ১২১-১৪ ব্যবধানে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পাস হয়েছে, যেখানে একটি পক্ষ হিসেবে হামাসকেই মেনে নেওয়া হয়েছে।
২৪ নভেম্বর শুরু হওয়া যুদ্ধবিরতি হামাসের মর্যাদাকে অন্যন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, যুদ্ধবিরতিতে আসাটা ইসরায়েলের জন্য বড় নৈতিক পরাজয় এবং হামাস ও অন্য প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর জন্য বিশাল মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিজয়। হামাসের বড় অর্জনটি হলো- একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতায় এসে তারা আন্তর্জাতিকভাবে রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। যে সংগঠনকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়ে আলোচনার জন্য পরিত্যাজ্য ঘোষণা করা হয়েছিল, মাত্র ৬ সপ্তাহের মাথায় তাদের মর্যাদার পরিবর্তন ঘটেছে। ‘সন্ত্রাসী’-র স্থলে হামাসের পরিচয় দাঁড়িয়েছে, তারাই ‘এই অঞ্চলের বৈধ নিয়ন্ত্রণকারী’।
এর আগে বিশেষত মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হলেও সেই চুক্তিগুলো এ-রকম পূর্ণাঙ্গ এবং বহুপক্ষের সম্পৃক্ততায় আন্তর্জাতিক মানের চুক্তি ছিল না। এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা হামাসের সঙ্গে মধ্যস্থতায় এসে প্রকাশ্যে চুক্তিকে সম্মান জানানোর কথা বলছে; দুই মাস আগেও এই বাস্তবতা অকল্পনীয় ছিল। বিশ্লেষকদের বক্তব্য, যুদ্ধবিরতির ফলে যুদ্ধের জন্য পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে হামাস। বিশ্রাম নিয়ে এবং পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে মানসিকভাবে চাঙ্গাও হয়েছেন যোদ্ধারা। তাছাড়া, গাজার অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ বহুগুণ বেড়েছে।
যুদ্ধবিরতিতে বন্দিবিনিময়ের সময় হামাস যে চৌকষ নৈপুণ্য দেখিয়েছে, তা বিশ^বাসীকে অবাক করেছে। বন্দিদের সঙ্গে তাদের ভালো ব্যবহার বিশ^ব্যাপী সমাদৃত হয়েছে। হামাসের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ইসরায়েলিরা গাজায় বন্দি থাকা অবস্থায় সদ্ব্যবহার পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, তাদেরকে গাজায় অতিথির মতো সেবা দেওয়া হয়েছে।
বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়া ইসরায়েলি নারী ড্যানিয়েল অ্যালোনির একটি লেখা সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। চিঠিতে হামাসের প্রতি তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সঙ্গে অকুণ্ঠ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মুক্তির আগে ড্যানিয়েল অ্যালোনি লিখেছেন, ‘আমি অন্তরের অন্তস্থল থেকে হামাসকে ধন্যবাদ দিতে চাই। কারণ, আমাদের দীর্ঘ সফরে হামাসের সামরিক বাহিনীর সদস্য থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাসহ যাদের সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাদের মধ্যে একজন মানুষও আমরা পাইনি, যিনি আমাদের সঙ্গে ভদ্র, যত্নবান ও আন্তরিক ছিলেন না।’ তিনি লেখেন, ‘হামাসকে যে কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে এবং গাজায় তাদের যে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে, তারপরও আমাদের প্রতি তাদের সদয় আচরণ আমরা আজীবন মনে রাখব।’
এই যুদ্ধের মাধ্যমে হামাসের সঙ্গে ইসলামিক জিহাদসহ অন্য প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো সম্পর্কে দারুণ উষ্ণতা তৈরি হয়েছে। হামাসের ৭ অক্টোবরের অভিযানের পরপরই অন্য প্রতিরোধ আন্দোলগুলো তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে যুদ্ধে যুক্ত হয়। শুধু ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনগুলো নয়, সিরিয়া, লেবানন, ইরাক এবং ইয়েমেনের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোও সর্বাত্মকভাবে হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলি বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস। আগের বন্দিবিনিময়ের ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, তাৎক্ষণিকভাবে বন্দিদের হস্তান্তরের স্থানে যেসব সাধারণ মানুষ উপস্থিত ছিলেন, তারাই বিষয়টি দেখতে পেরেছেন। কিন্তু, এ-দিনের ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, হামাস আগে থেকে ঘোষণা দিয়েই নির্দিষ্ট একটি স্কয়ারে জনতাকে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছে এবং সেখানে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। তারা ‘আল্লাহু আকবার’ ধ্বনি দিয়ে যোদ্ধাদের স্বাগত জানিয়েছেন। হস্তান্তর অনুষ্ঠান শেষে হামাস ও ইসলামিক জিহাদের যোদ্ধারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির নিদর্শন হিসেবে কোলাকুলি করেন। এককথায় বলা যায়, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর মধ্যে এমন ইস্পাতকঠিন ঐক্য আগে কখনও দেখা যায়নি।
যুদ্ধ এবং যুদ্ধবিরতির কারণে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে হামাসের প্রতি জনসমর্থন ব্যাপকহারে বেড়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘অ্যারাব ব্যারোমিটার’ পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে অভিযান পরিচালনার আগে হামাসের প্রতি ৬৭ শতাংশ গাজাবাসীর স্বল্প আস্থা কিংবা অনাস্থা ছিল। কিন্তু আরব-ভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, অভিযানের পর সেই সমর্থনের ধারা পাল্টে গেছে। অভিযানের আগে জরিপে অংশগ্রহণকারীরা বলেছিলেন, হামাস যেমনটা ইসরায়েলের বিলুপ্তি চায়, তারা তা চান না। বরং, তারা ইসরায়েলের পাশাপাশি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র চান। কিন্তু সংবাদমাধ্যমগুলো এখন বলছে, ইসরায়েলের নির্বিচার বর্বরতার পর গাজাবাসীর সেই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন অধিকাংশ গাজাবাসী ইসরায়েলের বিলুপ্তি চান।
শুধু গাজায় নয়, পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সেখানে প্রতিদিন আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে। তারা হামাসের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছেন এবং তাদের জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করছেন। যুদ্ধের শুরু থেকেই সেখানে হামাসের জনসমর্থন বাড়ছিল, হামাসের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তারাও যুদ্ধ করছিলেন। কিন্তু, পশ্চিমতীরের ফিলিস্তিনিদের মুক্তির পর সেখান হামাসের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়েছে। হামাসের প্রতিপক্ষ হিসেবে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ-কে যে গণ্য করা হতো, সেটি এখন আগের অবস্থায় নেই। এই যুদ্ধ ফাতাহ-র ভবিষ্যৎকে অনেকাংশে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। গাজাসহ পুরো ফিলিস্তিনি শাসনের দায়িত্ব মাহমুদ আব্বাসকে দেওয়ার যে পরিকল্পনা পশ্চিমারা নিয়েছেন, সেটির ভবিষ্যৎ এখন অস্পষ্ট। কারণ, ফিলিস্তিনের স্বীকৃত প্রতিনিধি এখন হামাস। এবং, পশ্চিমতীর কিংবা গাজা- সবখানে তাদের জনসমর্থন এখন আকাশচুম্বী।
যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর ইসরায়েলে অস্থিরতা তৈরি করে দিয়েছে হামাস। দেশটির উগ্রপন্থী জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গাভির পদত্যাগ করার হুমকি দিয়েছেন। বিরতির পর যুদ্ধ আবার শুরু না হলে সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন বলে জানান তিনি। ইসরায়েলি মিডিয়া খবর দিয়েছে, বেন-গাভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোত্রিচ প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার ভেঙে দিয়ে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনা করছেন বলে জানিয়েছেন। এই দুই মন্ত্রী যুদ্ধবিরতির ঘোর বিরোধী; তারা চান, হামাসকে নির্মূল করে গাজার শাসনভার ইসরায়েল গ্রহণ করুক।
ইসরায়েলকে অর্থনৈতিকভাবেও পঙ্গু করে দিয়েছে হামাস। যুদ্ধের কারণে বিদেশি কর্মীরা গণহারে ইসরায়েল ছেড়েছেন। তার ওপর তিন লাখ লোককে সামরিক রিজার্ভ ডিউটিতে ডাকার কারণে দেশটির শ্রমশক্তির বড় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ইসরায়েলে যে-কোনো সময় যে-কোনো জায়গায় বোমা পড়তে পারে। সে-কারণে দেশটিতে আগত পর্যটকদের সংখ্যা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। যুদ্ধের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রকল্প ও বিনিয়োগ স্থগিত বা বাতিল করা হয়েছে। প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোর হামলার কারণে গাজা ও লেবানন সীমান্তের বিশাল এলাকার অর্থনীতি এখন স্থবির। অনেক জায়গায় কৃষিকাজ নেই; উৎপাদন বন্ধ। তার ওপর গাজায় যে পরিমাণ ব্যয়বহুল বোমা তারা ফেলছে, তার পুষিয়ে আনা দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার।
শত্রুকে বিপর্যস্ত করে, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি আদায় করে, বৈশি^কভাবে বন্ধুর সংখ্যা বাড়িয়ে এবং ফিলিস্তিনিদের একমাত্র আশার প্রতীক হিসেবে নিজেকে প্রমাণিত করে হামাসের সম্মান এখন অনন্য উচ্চতায় আরোহণ করছে। শুধু হামাস নয়, সাধারণ ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় সৌভাগ্য বয়ে এনেছে এই যুদ্ধ। হামাসের সঙ্গে সুর মিলিয়ে অনেক বিশ্লেষকই বলছেন, এমন একটি সম্ভ্রান্ত ভবিষ্যৎ ফিলিস্তিনিদের জন্য অপেক্ষা করছে, যা আগে কখনও তারা দেখেননি। এমন একটি বিপর্যয়কর ভবিষ্যৎ ইসরায়েলিদের জন্য অপেক্ষা করছে, যা তারা কখনও কল্পনা করেননি।