গাজায় বর্বর হামলার কারণে সারা বিশ্বে ইসরায়েলের ইমেজ ক্ষুণ্ন হয়েছে। এখন ইমেজ পুনরুদ্ধারের জন্য দক্ষিণ গাজায় দ্বিতীয় দফা হামলার পক্ষে আন্তর্জাতিক বন্ধু ও মিত্রদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা জোরদার করছে তেল আবিব। এর অংশ হিসেবে, ভারতের উপরও চাপ দিচ্ছ ইসরায়েল, যাতে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, নেতানিয়াহুর ব্যপারে সতর্ক হওয়া উচিত নয়াদিল্লির। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভেদ জিইয়ে রেখে বৃহত্তর ইসরায়েল রাষ্ট্র গঠনের জন্য বিভিন্ন সময়ে বিতর্কিত পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। হামাসের ব্যাপারে কঠোর নীতি গ্রহণ করলে, সেটা শেষ বিচারে নয়াদিল্লির জন্য ইতিবাচক না-ও হতে পারে।
ইসরায়েলের কূটনীতিকরা নিজেদের মধ্যে এক ধরনের হিংস্রতা তৈরি করেছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এ রকম খুব একটা দেখা যাবে না। যে দেশে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তেল আবিবের নির্দেশ পেলে সে দেশের ওপর তারা সাথে সাথে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। এ ব্যপারে তাদের কোনো ধৈর্য নেই, ভদ্র সভ্য আচরণ করার কোনো দায় তারা অনুভব করেন না।
প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নিজেই এই সংস্কৃতি চালু করেছেন। ২০১৫ সালে তিনি ওয়াশিংটনের ক্যাপিটল হিলের আইন প্রণেতাদের সাথে লবিং করে একটা আমন্ত্রণ জোগাড় করেছিলেন। বিধি মোতাবেক এই প্রক্রিয়া হওয়ার কথা ছিল মার্কিন প্রেসিডেন্টের চ্যানেলের মাধ্যমে। কিন্তু তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে এড়িয়েই এই কাজটা করেছিলেন নেতানিয়াহু। কংগ্রেসের যৌথ অধিবেশনে তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ওবামা প্রশাসন যেহেতু ওই সময় তেহরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তির জন্য কাজ করছিল, সে কারণে এই ঔদ্ধত্য দেখিয়েছিলেন নেতানিয়াহু।
এ ধরনের সিদ্ধান্ত ছিল মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থায় খোলামেলা হস্তক্ষেপ। নেতানিয়াহু ওবামাকে শুধু খাটোই করেননি। বরং ওয়াশিংটনে তার প্রভাব যে প্রেসিডেন্টের চেয়ে কম নয়, সেটাই দেখিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের ইরান-নীতি কী হওয়া উচিত, তা নিয়েও হোয়াইট হাউজকে জ্ঞান দেওয়ার মতো ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন নেতানিয়াহু। এসব করেও তিনি পার পেয়ে গিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, আমেরিকান যে রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণি, তারা ইসরায়েলি লবির কাছ থেকে অর্থ নিয়ে টিকে আছে।
সম্প্রতি ভারতেও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে । মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত নাওর গিলোন প্রকাশ্যেই দাবি জানিয়েছেন, যাতে ফিলিস্তিনের ব্যপারে ভারত তাদের নীতি বদলায়। হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে। গিলোনের কূটনীতিকের ক্যারিয়ার প্রায় ৩৫ বছরের। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কূটনৈতিক শিষ্টাচার ও রীতি নীতি তিনি জানেন না। বোঝা যাচ্ছে, কূটনৈতিক পর্যায়ে হামাস ইস্যুতে তার কথাকে দিল্লি মোটেই কানে নেয়নি। আর সে কারণেই ভারতীয় মিডিয়ায় যে ইসরায়েলি লবি সক্রিয় আছে, তাদের দ্বারস্থ হয়েছেন গিলোন।
এখন এমন এক সময়, যখন মরিয়া হয়ে কূটনীতিক সাফল্য অর্জনের চেষ্টা করছে ইসরায়েল। কারণ, গাজায় যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা ইসরায়েলের মর্যাদাকে সম্পূর্ণ ধুলিস্যাৎ করে দিয়েছে। ইসরায়েল যে গণহত্যা চালাচ্ছে, এবং জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এই ধারণা আন্তর্জাতিক মহলে ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। মানবিক কারণে সাময়িক অস্ত্রবিরতির পর, আবারও গাজায় এই বর্বর হামলা শুরু করেছে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী।
আমেরিকার চাপে ইসরায়েল যদি তাদের কৌশল না বদলায়, তাহলে হামাসের সাথে সামনে অপেক্ষা করছে একটা দীর্ঘ সঙ্ঘাত। কিন্তু তেল আবিব কৌশল বদলাবে বলে মনে হচ্ছে না। এছাড়া পশ্চিমা চাপও তেমন দেখা যাচ্ছে না। জি-সেভেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সম্প্রতি যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তারা বলেছেন, মানবিক কারণে, এবং জিম্মিদের মুক্ত করার জন্য অস্ত্রবিরতির সময় বাড়ানো এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অস্ত্রবিরতির জন্য তারা সহায়তা দিয়ে যাবে।
কিন্তু বিবৃতির কোথাও স্থায়ী অস্ত্রবিরতির আহ্বান জানানো হয়নি। শুধু তাই নয়, ইসরায়েলের যে নিজেকে এবং তাদের জনগণকে রক্ষার অধিকার আছে, এবং জি-সেভেন যে তাদের এই অধিকারের ব্যপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তা আবার মনে করিয়ে দিয়েছে। বিবৃতি অনুযায়ী ইসরায়েল আসলে প্রতিরোধের চেষ্টা করছে, যাতে ৭ অক্টোবরের মতো হামলা আবার না ঘটে।
সারা পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন সহায়তা পেয়েও ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী এখন পর্যন্ত খুব একটা ভালো কিছু দেখাতে পারেনি। কিন্তু এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণে হামাসের সাথে গাজার মানুষের সমর্থন আছে। সে কারণে, সামনে আরও চরম সহিংসতা অপেক্ষা করছে। ইসরায়েল চেষ্টা করছে তার বন্ধু ও মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নেয়ার। যাতে গাজায় পরবর্তী দফা হামলায় এই দেশগুলোর সমর্থন পাওয়া যায়।
হামাসের বিরুদ্ধে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েলের অতীত ইতিহাস খুবই বিতর্কিত। সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট ও এহুদ বারাক পশ্চিমা নামি দামি কিছু মিডিয়ায় সাক্ষাতকার দিয়েছেন। সেখানে তারা অভিযোগ করেছেন, নেতানিয়াহুর কারণেই হামাসের উত্থান হয়েছে। কাতারের কাছ থেকে তারা তহবিল পেয়েছে। গাজা দখলের দায়িত্বে ছিল, ইসরায়েলের এ রকম এক সাবেক জেনারেলও স্বীকার করেছেন, হামাসের মধ্যে তিনি তহবিল বন্টন করেছেন। যদিও এমন তথ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে।
দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে চমকে যাওয়ার মতো যে সব তথ্য বেরিয়ে আসছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে নেতানিয়াহু আসলে বিভিন্ন চরিত্রে খেলছেন। ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত গিলোন দাবি তুলেছেন দিল্লি যাতে হামাসকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে। এখানে প্রশ্ন উঠবে হামাসের ঠিক কোন অংশের কথা বলতে চেয়েছেন তিনি। মারিভ হাশাভু ব্র্যান্ডের অধীনে প্রকাশিত ইসরায়েলের একটি হিব্রুভাষী দৈনিক পত্রিকা আরেকটি চমকে দেয়ার মতো প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যা নিয়ে ইসরায়েল জুড়ে চলছে তোলপাড়।
ইসরায়েলি দৈনিক মারিভের খবরে বলা হয়েছে, ২০১১ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে গাজায় হামাসের অন্যতম নেতা ইয়াহিয়া সিানাওয়ারসহ ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যান্য সিনিয়র নেতাদের হত্যার জন্য নেতানিয়াহুর সামনে ছয়টি বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছিল ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত। কিন্তু নেতানিয়াহু সব প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
ইসরায়েলের সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আভিগদোর লিবারম্যানও এই সংবাদের পক্ষে কথা বলেছেন। লিবারম্যানের মতে, নেতানিয়াহু সিনাওয়ারসহ হামাসের অন্য নেতাদের দায়মুক্তি দিয়েছেন। তাদেরকে নির্মূলের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি কোন ধারণা থেকে এই কথা বলছি না। এ বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যাচ্ছে হামাস নিয়ে ইসরায়েলের ভেতরে এখন নানা ধরনের দোষারোপের খেলা চলছে।
অনেকে মনে করেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে হামাসকে শক্তিশালী করার রেকর্ড নেতানিয়াহুর রয়েছে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ আর প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য ফিলিস্তিনের বিভিন্ন গোষ্ঠির মধ্যে ফাটল ধরাতে চেয়েছেন নেতানিয়াহু। সে জন্যেই এই সব পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। নেতানিয়াহুর চুড়ান্ত লক্ষ্য ছিল, যে কোন ধরনের শান্তি প্রক্রিয়া নস্যাৎ করে দেয়া। আর এর মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ করে বৃহত্তর ইসরায়েল গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।
মারিভের প্রতিবেদনটি লিখেছেন ইসরায়েলের একজন শীর্ষস্থানীয় সাংবাদিক বেন কাসপিত। তার মতে, নেতানিয়াহু হামাসকে গুরুত্বপূর্ণ 'সম্পদ' মনে করেন। হামাস তাকে দুই রাষ্ট্র সমাধান এড়াতে সাহায্য করবেন, এমনটাই মনে করেন তিনি। কাসপিত বলেন, নেতানিয়াহু হামাসকে প্রথম যে সুবিধা দিয়েছেন, সেটা হলো ২০১১ সালের বন্দি বিনিময় চুক্তি। সে সময় ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতের মুক্তির বিনিময়ে ১ হাজার ২৭ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়। এই ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সিনওয়ারও ছিলেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের উচিত হামাসের ব্যপারে নেতানিয়াহুর বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে স্বচ্ছ ধারণা নেয়া। গাজার সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে দোহায় যে ত্রিপক্ষীয় গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হলো হামাসের রাজনৈতিক নেতারা। দ্বিতীয় পক্ষ হলো কাতারের মধ্যস্থতাকারীরা। আর তৃতীয় পক্ষ হলো সফররত সিআইএ'র ডিরেক্টর এবং মোসাদের প্রধান।
যে কোন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো এই আন্দোলন কখনও মরে না। চুড়ান্ত বিশ্লেষণ অনুযায়ী, ভবিষ্যতে ফিলিস্তিনের যে কোন ধারণার সাথে হামাস থাকবে। যেমন ছিল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস বা এএনসি। অথচ ১৯৬০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছিল এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে এবং মিশর ও জর্ডানের পরোক্ষ সহায়তা নিয়ে ২০২১ সালের মে মাসে পশ্চিম তীরে আইনসভার নির্বাচনের আয়োজন ভেস্তে দিয়েছিলেন নেতানিয়াহু। তার আশঙ্কা ছিল হামাসের কাছে ফাতাহ হেরে যেতে পারে। সে জন্যেই এই ষড়যন্ত্র করেছিলেন তিনি। ওই অঞ্চলে যে জনমত জরিপ চালানো হয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল হামাস বড় ব্যবধানে জিতে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। '
দিল্লিতে নিযুক্ত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত এখন ভারতের কাছে প্রতিদান চাইছেন। কারণ পাকিস্তান-ভিত্তিক লস্করে তৈয়বাকে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরায়েল। কিন্তু এই তুলনা খুবই হাস্যকর। লস্করে তৈয়বা একটি পাকিস্তান-ভিত্তিক সংগঠন যা ভারত ও আফগানিস্তানে সক্রিয়।
অন্যদিকে, হামাস হলো ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব প্রতিরোধ আন্দোলন, যাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো ইসরায়েলের দখলদারিত্ব থেকে তাদের ভূখন্ডকে মুক্ত করা। হামাস ফিলিস্তিনিদের জাতীয়তাবাদকে ইসলামের আলোকে উপস্থাপন করেছে। তারা জোর দিয়ে বলেছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের লক্ষ্য হওয়া উচিত ফিলিস্তিনি নাগরিকদেরকে জন্য কাজ করা, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাদের অধিকার ও জাতীয় প্রকল্পগুলোর সুরক্ষা দেয়া। হামাস যে বিষয়ে জোর দেয়, তা হলো ফিলিস্তিনিদের জাতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা রক্ষা করা এবং ফিলিস্তিনি জনগণের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।
হামাসের সাথে তুলনা হতে পারে নর্দার্ন আয়াল্যান্ডের সিন ফেইন ও তাদের সামরিক শাখার সাথে। সিন ফেইনের সামরিক শাখা আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি নামে পরিচিত। নর্দার্ন আয়াল্যান্ডে বিগত প্রায় ২৫ বছর ধরে যে শান্তি বিরাজ করছে, তার কারণ হলো ১৯৯৮ সালের গুড ফ্রাইডে এগ্রিমেন্ট। ফিলিস্তিনে কিভাবে শান্তি আনা সম্ভব তার ধারণা এই চুক্তি থেকে নেওয়া যেতে পারে। ফিলিস্তিনের ব্যপারে যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ভারতের উচিত ইতিহাসের ব্যাপারে গভীর ধারণা নেওয়া।