মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধ সংগঠনগুলো যে দোর্দণ্ড প্রতাপে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে আক্ষরিক অর্থেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে ইসরায়েল এবং তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। এই সপ্তাহে গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধারা এমন কিছু হামলা পরিচালনা করেছেন, যাতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মনোবলে ধস নেমেছে। এর মধ্যে বহিরাবরণে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব না মানার ভান করলেও এর পেছনে আঁঠার মতো লেগে আছে তার মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। ওয়াশিংটনের দ্বিমুখী আচরণও বেশ আলোচিত হচ্ছে। তারা একদিকে দক্ষিণ-গাজার মিসর সীমান্তবর্তী রাফায় ইসরায়েলি অভিযানে দ্বিমত পোষণ করছেন, ফিলিস্তিনি হত্যার রাশ টানতে বলছেন, আবার ফিলিস্তিনিদের হত্যার জন্য ইসরায়েলকে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলারও দিচ্ছেন; একইসঙ্গে ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস, ইসলামিক জিহাদসহ অন্য প্রতিরোধ সংগঠনের সামরিক শাখাগুলো দৃঢ়তার সঙ্গে দখলদার ইসরায়েলি সেনাদের মোকাবিলা করছে। এই সপ্তাহে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য হামলা চালিয়েছে হামাসের আল-কাসসাম ব্রিগেডস। সোমবার তারা দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস শহরের পূর্বে আবাসান এলাকায় এক হামলায় একেবারে কাছ থেকে ১০ ইসরায়েলি সেনাকে নির্মূল করেছেন। এ-সময় একই এলাকায় আল-কাসসামের যোদ্ধারা অ্যান্টি-পার্সোনেল এক্সপ্লোসিভ ডিভাইসের বিস্ফোরণও ঘটান, যেখানে আরও কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা নিহত হন। অতর্কিত হামলায় বেশ পারদর্শিতা দেখাচ্ছেন সব প্রতিরোধ সংগঠনের যোদ্ধারা। সোমবার এমন একটি হামলা চালিয়েছে ইসলামিক জিহাদের আল-কুদস। খান ইউনিসের পূর্বে মায়েন শহরে একটি ইসরায়েলি সেনাদলের আসার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। সেনারা আসা-মাত্র কুদসের যোদ্ধারা অ্যান্টি-পার্সোনেল শেল, থার্মোবারিক শেল এবং অ্যাসল্ট রাইফেল দিয়ে মুহুর্মুহু হামলা চালাতে থাকেন। এতে অনেক সেনা নিহত হন। সপ্তাহজুড়ে সক্রিয় অবস্থানে ছিল প্রতিরোধ সংগঠনের মর্টার বাহিনীগুলোও। ইসরায়েলি সেনাদের অবস্থান করা ভবনগুলোতে অসংখ্য মর্টার ছুড়েছেন তারা। অনেক ইসরায়েলি সেনার প্রাণহানি ঘটেছে আগে থেকে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পুঁতে রাখা বিস্ফোরকে। এই সপ্তাহে গাজায় গেঁড়ে বসা ইসরায়েলি সেনা অবস্থানে এবং ইসরায়েলের ভেতরের বসতিগুলোতে বিপুল পরিমাণ রকেটও ছুড়েছেন তারা।
এই সপ্তাহে সিনিয়র কর্মকর্তাসহ বহু সেনা হারিয়েছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি সামরিক পরিসংখ্যানের বরাতে জাতিসংঘ বলেছে, গাজায় স্থলযুদ্ধে এ-পর্যন্ত ২৩০-এর মতো ইসরায়েলি সেনা প্রাণ হারিয়েছেন। ৭ অক্টোবর হামাসের আল-আকসা ফ্লাড অভিযানে নিহত সেনাসহ এ-পর্যন্ত মোট নিহত ইসরায়েলি সেনাসংখ্যা দাঁড়াল ৫৭০-এর বেশি।
এমন কোনো দিন নেই, যে-দিন ইরাকি প্রতিরোধ যোদ্ধারা কোনো না কোনো মার্কিন স্থাপনার বিরুদ্ধে হামলা চালাননি। সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে একটি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে মঙ্গলবার রাতে এক ঘণ্টার ব্যবধানে তিন দফা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়েছে। প্রথম দফায় দুটি এবং দ্বিতীয় দফায় আরও তিনটি মিসাইল ঘাঁটিতে আঘাত হানে। মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এ-সব ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে পারেনি। তৃতীয় দফায় ১০টিরও বেশি মিসাইল নিক্ষেপ করা হয়। হামলায় প্রকম্পিত ঘাঁটিতে আগুন ধরে যায়। ইরানি মিডিয়া বলেছে, দেইর আজ-জোর প্রদেশের আল-ওমর তেলক্ষেত্রের মার্কিন সেনাঘাঁটিতে এই হামলা হয়। তিনদিনে তৃতীয়বারের মতো চালানো এই হামলায় বিপুল ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া গেছে।
লেবাননের হিজবুল্লাহকে সমঝোতার টেবিলে আনতে কয়েক সপ্তাহ ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন পশ্চিমারা। এমনকি সমঝোতার লিখিত প্রস্তাবও দিয়েছে ফ্রান্স। কিন্তু প্রতিরোধ সংগঠনটি সাফ বলেছে, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ না হলে তাদের হামলাও বন্ধ হবে না। হিজবুল্লাহর মহাসচিব সাইয়েদ হাসান নাসরাল্লাহ বলেছেন, ইসরায়েলি সেনাদের বর্বর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যে-যুদ্ধ চলছে, তাতে চূড়ান্ত পর্যায়ে ফিলিস্তিনিরাই বিজয়ী হবেন। এ-সপ্তাহে প্রকাশিত ইসরায়েলের রিচম্যান ইউনিভার্সিটির কাউন্টার-টেরোরিজম পলিসি ইনস্টিটিউটের ১০০ জন বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধে গেলে ইসরায়েলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এটি হতে পারে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ।
হিজবুল্লাহ সপ্তাহের সাতদিনই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলে। ইসরায়েলি নজরদারি স্থাপনা, সেনা-সমাবেশ এবং অবস্থানগুলোতে দিনে ৫ থেকে ১৫ দফা পর্যন্ত হামলা চালিয়েছেন তারা। সংগঠনটি বলেছে, ৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে এ-পর্যন্ত ইসরায়েলে ১ হাজার ১৩ বার হামলা চালিয়েছেন তাদের যোদ্ধারা। ইসরায়েলি গবেষক মোরান আলুফ সম্প্রচারমাধ্যম কান-কে বলেছেন, হিজবুল্লাহর সামরিক নীতি হলো- ইসরায়েলের উত্তরে বসতি স্থাপনকারীদের জিম্মি করে রাখা। ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা দক্ষিণের লোকজনকে বন্দি করেছেন, আর হিজবুল্লাহর যোদ্ধারা উত্তরের লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন। হিজবুল্লাহর হামলার কারণে বসতি স্থাপনকারীরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না। উত্তর ইসরায়েলের মেতুলার মেয়র জানিয়েছেন, গাজাযুদ্ধের পর ৮০ হাজার বসতি স্থাপনকারী উত্তরাঞ্চল ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ইয়েমেনের হুথি আনসার-আল্লাহর অভিযানগুলো অবাক করার মতো। যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য মিলে তাদের অবস্থানে মুহুর্মুহু হামলা চালাচ্ছেন; কিন্তু হামলার পরপরই মার্কিন, ব্রিটিশ ও ইসরায়েলি জাহাজে অসংখ্য ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছেন তারা। সঙ্গে ড্রোন হামলাও হচ্ছে। হুথি সমর্থিত সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের সদস্য মোহাম্মদ আলী আল-হুথি বারবার বলছেন, যতদিন গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসন অব্যাহত থাকবে, ততদিন ইয়েমেনের সশস্ত্র বাহিনীর অভিযানও চলবে। তিনি বলেন, গাজার সব অংশে যখন খাদ্য, ওষুধ এবং মানবিক সহায়তা পৌঁছাবে এবং ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা বন্ধ হবে, তখনই ইয়েমেনের অভিযান বন্ধ হবে। সংগঠনের নেতা সৈয়দ আবদুল মালিক আল-হুথি মঙ্গলবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আমরা গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করেছি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে ইসরায়েল-সংশ্লিষ্ট একটি জাহাজও লোহিত সাগর পাড়ি দিতে পারেনি।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এখন দিশাহারা অবস্থায় পড়েছেন। উত্তর-মধ্য-দক্ষিণ গাজায় প্রতিরোধ যুদ্ধ ঠেকাতে না পেরে মিসরের সীমান্তবর্তী রাফাহ শহর নিয়ন্ত্রণ করে গাজাকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছেন তিনি। গাজার সঙ্গে মিসরের সীমান্ত রেখা বরাবর ‘ফিলাডেলফি রুট’ দখল করতে সম্প্রতি বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাফায় হামলা তীব্র করার নির্দেশ দেন। এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। মিসর বলেছে, ইসরায়েল রাফায় স্থল-অভিযান চালালে তেলআবিবের সঙ্গে করা শান্তিচুক্তি থেকে সরে আসবে কায়রো। এই পরিস্থিতিতে মিসর তাদের সীমান্তে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। ক্রসিংয়ের আশপাশে বেশ কয়েকটি ‘এম-সিক্স-জিরো-এ-থ্রি’ যুদ্ধট্যাঙ্ক এবং ‘ওয়াই-পি-আর-সেভেন-সিক্স-ফাইভ’ পদাতিক যুদ্ধযান মোতায়েন করেছেন তারা। উত্তর ও মধ্যগাজায় ইসরায়েলি হামলার কারণে এই রাফাহ শহরে প্রায় ১৫ লাখ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি আশ্রয় নিয়েছেন এবং গাজার সঙ্গে অন্যদেশের যোগাযোগের এটিই একমাত্র স্থল-সংযোগ। ইসরায়েল রাফায় স্থল-অভিযান শুরু করলে তাদের সঙ্গে বন্দিবিনিময় আলোচনা বাতিল করার হুমকি দিয়েছে হামাস।
এদিকে, রাফায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধ করতে আন্তর্জাতিক আদালতে একটি জরুরি আবেদন জানিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। দেশটি বলেছে, তারা ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিস বা আইসিজে-কে বলেছে, ইসরায়েল রাফায় সামরিক অভিযান চালানোর কথা জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক আদালত তার ক্ষমতা ব্যবহার করে ইসরায়েলকে থামিয়ে ফিলিস্তিনিদের অধিকার রক্ষা করুক। দক্ষিণ আফ্রিকা জানিয়েছে, ইসরায়েল রাফায় যে সামরিক অভিযানের কথা বলেছে, এতে বিপুল মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। তারা বলছেন, এটি এ-বছরের ২৬ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক আদালতের দেওয়া রায় এবং জেনোসাইড কনভেনশনেরও বিরোধী। দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনের প্রেক্ষিতে গত মাসে আইসিজে রায় দিয়েছিল, গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে ইসরায়েল যেন সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়। কিন্তু এই রায় প্রত্যাখ্যান করেছে ইসরায়েল।
এই সপ্তাহে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ, নতুন নির্বাচন আয়োজন এবং গাজায় বন্দি ইসরায়েলিদের মুক্তির জন্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে চুক্তির দাবিতে ইসরায়েলজুড়ে বড় বড় বিক্ষোভ হয়েছে। হাজার হাজার বসতি স্থাপনকারী তেলআবিবের হা-বিমা স্কয়ারে জড়ো হয়ে কাপলান স্ট্রিট অবরোধ করে রাখেন। জেরুজালেমে নেতানিয়াহুর বাসভবনের সামনেও বিক্ষোভ হয়। হাইফার হোরেভে প্রায় ৩ হাজার মানুষ মিছিল করেন, যেখানে ব্যানারগুলোতে লেখা ছিল- ‘এখনই নির্বাচন চাই’। খবরে বলা হয়, বন্দিদের উদ্ধারের দাবিতে তাদের স্বজন এবং মানবাধিকার কর্মীরা আয়ালোন সড়ক অবরোধ করে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেন।
ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তিতে নেই নেতানিয়াহু। প্রতিটি পদক্ষেপে হারতে বসা জনসমর্থনহীন এই প্রধানমন্ত্রী পাগলের মতো একেকটি নির্মম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, যার প্রতি পৃথিবীর কারও সমর্থন থাকছে না। চূড়ান্তভাবে হেরে যাওয়ার সময় সমাগত, তাই ক্ষমতা ধরে রাখতে জনগণকে খুশি করার চেষ্টায় ফিলিস্তিনিদের ওপর গণহত্যায় মেতেছেন নেতানিয়াহু। কিন্তু, জনগণও সেই গণহত্যার বিরুদ্ধে। তাহলে, নেতানিয়াহুর টিকে থাকার আর জায়গা কোথায়!