উৎসুক মন, শুধু প্রশ্নের উত্তর খোঁজে; কোনটা সত্য, কোনটা অর্ধসত্য, কোনটা মিথ্যা- এর ব্যবধান অনুসন্ধানে ব্যাকুল থাকে। একটা সময় ঠিকই সত্যকে মিথ্যা থেকে আলাদা করতে পারলেন তিনি। ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে নিলেন মোলেনদিক।
জেনি মোলেনদিক দিভলেলি। ইশারা ভাষার কানাডীয় ইংরেজি শিক্ষিকা। ২০০৬ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন।
নিজের জীবনে ইসলামের সৌন্দর্য মেখেই বিশ্রাম নেননি তিনি। চেয়েছেন ইসলামকে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে। ভেবেছেন, যেখান থেকে চিন্তার উন্মেষ ঘটে, ঠিক সেখানে ইসলামের অনুশীলন ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন। তিনি টার্গেট করলেন শিশুমনকে, যারা সত্যকে নির্দ্বিধায় ধারণ করতে পারে। শুরু হলো সেই যাত্রা।
এখন তিনি শিশুদের কাছে ইসলামকে সহজ করে তুলে ধরার কাজ করছেন। সে উদ্দেশ্যে তার পাঁচ শিশুকে নিয়ে বানানো ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করছেন জেনি। ভিউ হচ্ছে, লাইক বাড়ছে, উৎসাহ পাচ্ছেন তিনি। মন্দ কিছুও যে শুনতে হচ্ছে না তা নয়। তিনি জানেন, ইসলামের সুন্দর শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে গেলে বাধা আসবেই। এবং, সেই বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
নয় বছর ধরে ইস্তাম্বুলে, যেখানে তিনি ইংরেজি ভাষা শিখিয়ে যাচ্ছেন। শিশুদের জন্য শিক্ষা ও তথ্যপণ্য বানানোর কাজ করছেন। বড়, তাত্ত্বিক কোনো বিষয় নয়, দৈনন্দিন জীবনে যা প্রয়োজন, তা-ই তার বিষয়। ছোটখাট ইস্যু ধরে তুর্কি ও ইংরেজি ভাষায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও পোস্ট করে তিনি ইসলাম ও হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন তুলে ধরছেন। নবীজির আদর্শ শিশুদের চিন্তা, মেধা, মননে অঙ্কুরিত করার চেষ্টা করছেন।
তুরস্কের সংবাদমাধ্যম আনাদুলু এজেন্সিকে মোলেনদিক জানান, এক পুলিশ কর্মকর্তা ও এক নার্সের পরিবারে দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে রক্ষণশীল খ্রিস্টান পরিবারে তার বেড়ে ওঠা। ‘লিঙ্গুইস্টিকস অ্যান্ড ইন্টারপ্রিটিং আমেরিকান সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ’-এ গ্র্যাজুয়েট করার সময় জীবনের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ের উত্তর খুঁজছিলেন তিনি। এ সময় তার উৎসুক মন মুসলিমদের সঙ্গে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তে তাকে বাধ্য করত। সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত বিরতি নিতে চাইত না।
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘ গবেষণার পর ২০০৬ সালের ১৪ মার্চ আমি অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাই। বুঝতে পারি, ইসলামই শ্রেষ্ঠ, এর চেয়ে বড় কিছু নেই। আমি ইসলামে দাখিল হই। এটিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত।’
প্রথমে তার বাবা এবং প্রশিক্ষক দুজনই এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তাকে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনায় রাজি করাতে চেয়েছিলেন। তাদের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। কিন্তু পারেননি; সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন মোলেনদিক। এ সময় তিনি সামি দিভলেলি’র সঙ্গে দেখা করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর ২০১২ সালে ইস্তাম্বুল চলে আসেন তারা।
তিনি বলেন, ‘ইসলাম সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না। আমি জানতাম না মুসলিম কারা, অথবা কিসে তাদের বিশ^াস। আমি জানতাম না যে, মুসলিমরা একই নবি-পয়গম্বরে বিশ^াসী। আমি তখন ইশারা ভাষার ব্যাখ্যা শিখছিলাম, ভেবেছিলাম, একদিন মসজিদেও তো আমার এ অনুবাদের কাজ করার প্রয়োজন পড়তে পারে, তাই ইসলাম সম্পর্কে আরও গবেষণাকাজ শুরু করি।’
মোলেনদিক জানান, তখন তার বিশ^াসের নতুন দরজা খুলে যাচ্ছিল এবং ভালো মানুষ হিসেবে তিনি পথচলা শুরু করেছিলেন। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ইসলামই সঠিক পথ। এ পথই সুন্দর, সহজ-সরল। শুদ্ধতার জন্য এ পথের বিকল্প নেই।
নতুন চিন্তা ও আদর্শ ধারণ করার প্রতিক্রিয়া তার জীবনেও ঘটেছিল। তিনি অন্যমনষ্ক হয়ে পড়তেন। চিন্তিত হয়ে পড়তেন। দ্বিধায় ভুগতেন। উদ্বেলিত হতেন, কুঁকড়েও যেতেন।
তিনি জানান, ইসলাম নিয়ে তিনি যখন গবেষণা করছিলেন, তার জীবনযাত্রা একেবারে বদলে যাচ্ছিল। যা তার মধ্যে ভয়ের উদ্রেক করেছিল। কিন্তু, এক সেমিনারে একজন মুসলিম লেকচারারের বক্তব্যে তার সেই ভয় কেটে গিয়েছিল এবং আরও অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন। যে প্রশ্নগুলোর উত্তর একদিন আগেও পুরোহিতরা তাকে দিতে পারেননি, সেই উত্তরগুলোই সেদিন পেয়েছিলেন মোলেনদিক। এরপর সিদ্ধান্ত নিতে তাকে আর বেগ পেতে হয়নি। কোনো জটিলতার সমাধানসূত্র খুঁজে পাওয়ার পর সবাই যখন খুশিতে আটখানা হন, তিনিও হয়েছিলেন।
তিনি বলেন, আমার স্বামীর কাছে চিঠি লিখলাম, তখন তিনি আমার বন্ধু। তাকে জানালাম, আমি সমাধান পেয়ে গেছি, আমি ইসলাম গ্রহণ করতে যাচ্ছি। আল্লাহ আমার স্বামীর প্রতি রহম করুন, তিনি আমার শহরে চলে এসেছিলেন। ওইদিনই আমি মুসলিম হই এবং ইসলামি বিধান অনুযায়ী পর্দা গ্রহণ করি। ইসলাম শুধু বিশ^াসের বিষয় নয়, মুখ ও শরীরী ভাষায়ও তা প্রকাশ করার বিষয়।
যে সংস্কৃতিতে তিনি জীবন ধারণ করছেন, তা ধরে রাখতে ইসলাম গ্রহণের পর প্রথমে স্কার্ফ না পরার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু না, তাতে বিধান পরিপালিত হবে না। ইসলাম এমন একটি ধর্ম, যা বিশ^াসে ধারণ করার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গেও ধারণ করতে হয়। এরপর তিনি পুরো শরীরকে ইসলামের চাদরে ঢেকে রেখেছেন।
ইসলাম কবুল করার সময়কার স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে গিয়ে মোলেনদিকের গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছিল। তিনি জানান, তার সিদ্ধান্ত বড়ভাই মেনে নিয়ে তাকে সহায়তা করছিলেন, আর বাবা-মা এর বিরোধিতা করেই যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, যাদের কোলেপিঠে বড় হওয়া, তাদের উপেক্ষা করাটা কতটা কঠিন, সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। আমি এটাও বুঝতে পারছিলাম, ইসলাম সত্য, এবং যা সত্য, তা সবসসময় সত্য। ভালোবাসার আলিঙ্গনে চিরন্তন সত্যকে ঢেকে রাখাটা অন্যায্য হবে।
ওয়েবসাইটে ইসলাম নিয়ে খুঁজে পাওয়া নেতিবাচক বিষয়গুলো কপি করে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন বাবা। তিনি আমাকে বোঝাতে চেয়েছিলেন, এটাই ইসলাম, যেটা তুমি পছন্দ করেছ। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমি তাকে বুঝিয়েছি, কিন্তু তিনি ইসলামকে বুঝতে পারেননি। তিনি শুধু সেটিই দেখেছেন, যেটি টেলিভিশনে দেখানো হয়। আমরা এমন একটা সমাজে বাস করি, যেখানে আমি দেখি একটা, মিডিয়াতে দেখানো হয় আরেকটা। কিন্তু আমি যেটা দেখতে পাচ্ছি, সেটাই চাক্ষোষ। যেটা মিডিয়াতে দেখানো হচ্ছে, সেটা বিভ্রম।
আমার মা আরও বেশি ভয় পেয়েছিলেন। তিনি ভয় পেয়েছিলেন এই ভেবে যে, বিয়ের পর আমার সঙ্গে তার দেখা হবে না, আমার সন্তানকে তিনি দেখবেন না। বিল্ডিংয়ের বেইসমেন্টে তালাবদ্ধ এক অন্ধকার কক্ষে আমরা বসবাস করব। কী অদ্ভুত, পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন, স্মার্ট ও আধুনিক একটা আদর্শকে কীভবে নোংরা ক্যামেরা দিয়ে তুলে আনা হচ্ছে!
স্কুলেও বিভিন্ন জনের কাছ থেকে তাকে অনেক প্রতিক্রিয়া মোকাবিলা করতে হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘সবাই হতবাক হয়েছিলেন। বিশ^বিদ্যালয়ে আমার প্রশিক্ষক ব্যক্তিগত কক্ষে আমাকে ডেকে জানতে চেয়েছিলেন, কী হয়েছে আমার। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, আমার মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা হয়েছে। আমার বস যখন বারবার একই প্রশ্ন করছিলেন, আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম, চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম।
যখন বিয়ে করেন মোলেনদিক, তখন পাত্র সামি দিভলেলি পড়ালেখা ও কাজের কারণে কানাডায় অবস্থান করছিলেন। বিয়েতে শুধু ভাই উপস্থিত ছিলেন। তবে ছয়মাস পর ইস্তাম্বুলে যখন তারা অনুষ্ঠান করেন, মা সেখানে হাজির হন।
মোলেনদিক বলেন, ‘২০০৮ সালে কানাডায় আমাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। আমি চেয়েছিলাম একটি মুসলিম সমাজ দেখে আমাদের সন্তানরা বেড়ে উঠুক, যেখানে স্থানীয় ভাষার সঙ্গে আরবিও শিখবে তারা, তাদের কানে আজানের শব্দ আসবে।
স্বামীর পরিবার নিয়েও বললেন মোলেনদিক। বললেন, তারা তাকে মেয়ের মতো দেখতেন। তবে ভাষাগত সমস্যা ছিল। তারা ইংরেজি জানতেন না, আর তিনি তুর্কি জানতেন না। সেই জটিলতা কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছিল।
তুরস্কের জীবনকে একেবারে অন্যরকম বর্ণনা করে তিনি জানান, যখন কানাডায় ছিলেন, হেডস্কার্ফ পরে বেরোলে সবাই তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকত। মনে করত, এ-ই বুঝি অন্য গ্রহ থেকে আসা কেউ।
যখন তুরস্কে এলাম, ভেবেছিলাম, কেউ আমার দিকে তাকাবে না। কিন্তু সেটা হলো না। তারাও আমাকে দেখে কৌতূহলী হলেন। তারা জানলেন আমি বিদেশি। তারা আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলেন। কিন্তু তারা আমার প্রতি মায়া-মমতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমার সঙ্গে তারা আনন্দ-কষ্ট সমান ভাগাভাগি করলেন।
মোলেনদিক বললেন, ‘আমি ইস্তাম্বুল এবং তুরস্ককে অনেক ভালোবাসি। সন্তানদের এখানেই বড় করতে চাই। আমার সন্তানরা ইসলাম নিয়ে খুশি, ইসলামকে ভালোবাসে, মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পথপ্রদর্শক হিসেবে মানে।’
ভালো থাকুন জেনি মোলেনদিক, ভালো থাকুন সামি দিভলেলি, ভালো থাকুন তার সন্তানরা।