টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বের মুসলিমরা পবিত্র রমজান মাস করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে ভিন্ন আঙ্গিকে পালন করতে যাচ্ছে। কোভিডের বিস্তার বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষকে প্রভাবিত করেছে। অনেক সরকার ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে নতুন করে লকডাউন দিয়েছে এবং স্বাস্থ্যবিধিতে বিশেষভাবে কঠোরতা আরোপ করেছে।
অনেকে ‘নিউ নরমাল’ ধারণার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর উপায় খুঁজছিলেন। কিন্তু সব চেষ্টা প্রতিহত করে পৃথিবীর সর্বত্র আবার জোরেশোরে চেপে বসেছে ভাইরাসটি।
এ মহামারি যে মুসলিমদের পবিত্র মাসটিকে এবারও বিশেষভাবে প্রভাবিত করবে, সন্দেহের অবকাশ নেই।
রমজান ইসলামিক ক্যালেন্ডারে সবচেয়ে সম্মানিত মাস। মহাগ্রন্থ আলকুরআন এ মাসে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাজিল করেছিলেন। সম্মানিত মাসটি উদযাপনের প্রস্তুতি মুসলিমরা কয়েক সপ্তাহ আগেই শুরু করেন।
রমজানের প্রস্তুতি হিসেবে অনেকে এর আগেই রোজা পালন করেন। পুরো মাসের জন্য ইফতার ও সেহরির জন্য বিশেষ খাদ্যসামগ্রী মজুদ করে রাখতে পছন্দ করেন।
মহামারির প্রকোপের কারণে গত বছর এ মাসের বাজার-সদাইয়ে মুসলিমদের বেগ পেতে হয়েছিল। অনেক দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে দোকানিরা রমজানের নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল নিত্যপণ্যকে ঘিরে।
এ মাসে সামাজিকতার শিক্ষা দেয় ইসলাম। পরিবারের সবাই একত্রিত হয়ে ইফতার এবং সেহরি করেন। কিছু লোক এ মাসে পবিত্র স্থানগুলোতে জড়ো হন। কিন্তু এসব আয়োজনে এবার নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ফলে চাইলেও একত্রিত হওয়া কিংবা পবিত্র স্থানগুলোতে এবার সফর করা সম্ভব হবে না।
ইফতারের সময় মুসলিমরা মসজিদে একত্রিত হন। একসঙ্গে ইফতার করেন এবং জামায়াতে মাগরিবের নামাজ পড়েন। তাছাড়া, জুমার নামাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ খুতবা দেন খতিবরা। এবার অনেক দেশে সেটা সম্ভব হবে না। কেউ কেউ ভার্চুয়ালি খুতবা প্রদানের ব্যবস্থা করলেও সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে যে সন্তুষ্টি অর্জিত হয়, তা ভার্চুয়াল মাধ্যমে হবে না।
রমজানে রোজা রাখা মুসলিমদের জন্য ফরজ। শিশু, গর্ভবতী, ঋতুবর্তী, অসুস্থ এবং ভ্রমণকারী ছাড়া সবাইকে এ ইবাদত আবশ্যিকভাবে পালন করতে হয়। এবার যারা কোভিড-আক্রান্ত এবং শারীরিকভাবে সক্ষম নন, শরিয়তের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের রোজা রাখতে হবে না। তবে পরে আদায় করে দিতে হবে।
এ বছর কয়েকটি দেশ নির্বিঘ্ন রোজা রাখার স্বার্থে রাতে ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে। অবশ্য, অধিকাংশ আলেম বলেছেন যে, কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার কারণে রোজা নষ্ট হবে না। এ মাসে মুসলিমদের টিকা গ্রহণের প্রবণতা কমতে পারে আশঙ্কায় প্রচার কর্মসূচি নিয়েছে অনেক দেশ। এতে ফল আসবে বলে আশাবাদী ব্রিটেনসহ অনেক দেশ।
ব্রিটেনের অনেক মুসলিম চিকিৎসক কোভিড ভ্যাকসিন নেওয়ার জন্য মুসলিমদের উৎসাহ জোগাচ্ছেন এবং মিথ ও মিথ্যাচার দূর করার চেষ্টা করছেন। দেশটিতে অনেক মসজিদ টিকাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
নির্দেশনা মোতাবেক সূর্যাস্ত পর্যন্ত মুসলিমরা রোজা পালন করেন, সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করেন। এ উপলক্ষে ইফতার মাহফিল আয়োজন অনেক দেশেই রীতি হিসেবে চলে আসছে। এবার বিধিনিষেধের কারণে এ ধরনের আয়োজন বিঘ্নিত হবে।
মহামারির আগে মসজিদ, দাতব্য সংস্থা এবং অনেক ব্যক্তি রমজানে একসঙ্গে ইফতারের বিশেষ আয়োজন করতেন। অনেকে আবার কম দামে যাতে ইফতার করতে পারেন, সে-রকম ব্যবস্থাও রাখা হতো। তাছাড়া, বিভিন্ন শপিং মলে তৈরি ইফতারের পসরা বসত। এবার তা ব্যাহত হবে।
এশা নামাজের পর মুসলিমরা মসজিদে তারাবিহ আদায় করেন। জামাতে আদায় করা হলে এ নামাজে বেশি সওয়াব নসিব হবে, এ বিশ্বাসে এ উপলক্ষে মসজিদে ভিড় হয়। কিন্তু, এবার মধ্যপ্রাচ্যের মতো বিশ্বের অনেক মসজিদ বন্ধ রয়েছে। আবার কিছু জায়গায় তারাবির জন্য বিশেষ নির্দেশিকা দিয়েছে।
সৌদি আরবের মসজিদে নববি কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেছে, বাধ্যতামূলক সামাজিক দূরত্বের মধ্যে সেখানে একসঙ্গে ৬০ হাজার মুসল্লি এ নামাজ আদায় করতে পারবেন। মহামারির আগে সেখানে একসঙ্গে সাড়ে তিন লাখ মুসল্লির নামাজ আদায়ের সুযোগ ছিল।
গত বছর ভাইরাসের বিস্তার রোধে সৌদি সরকার মসজিদ আলহারাম এবং মসজিদে নববিতে তারাবিহ নামাজ স্থগিত করেছিল। এবার তারাবিহ জামাতে আদায়ের সুযোগ পেলেও সেখানে উপস্থিতি সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এক-ষষ্ঠাংশে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষ গত বছর তারাবিহ নিষিদ্ধ করলেও এবার পড়ার অনুমতি দিয়েছে। তবে একসঙ্গে জড়ো হয়ে ইফতারের আয়োজন কিংবা ইফতার বিতরণ নিষিদ্ধ করেছে।
মিসরে সামাজিক দূরত্বের সঙ্গে কয়েকটি মসজিদে তারাবিহ নামাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিছু মসজিদ থেকে নামাজ সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যাতে মুসল্লিরা ঘরে বসে নামাজ অনুসরণ করতে পারেন। সেখানে ধর্মীয় আলোচনা এবং খুতবা অনলাইন এবং সোস্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হবে।
রমজানের শেষ দশদিন অনেক মুসলিম স্রষ্ঠার সন্তুষ্টির জন্য গভীর ইবাদতে মশগুল হন। একে বলা হয় ‘ইতিকাফ’। তাছাড়া, শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে মুসলিমরা লাইলাতুল কদর পালন করেন। যেহেতু এ রাতের নির্দিষ্ট উল্লেখ নেই, সে কারণে মুসল্লিরা বেজোড় রাতগুলোর প্রত্যেকটিতে দীর্ঘ বিশেষ ইবাদতে নিবিষ্ট থাকেন। এ সময় কিছু মুসলিম মসজিদেই বাস করেন। এ বছর অনেক মসজিদ ইতেকাফের অনুমতি দেবে না। এতে চিরাচরিত ধর্মীয় এ ক্রিয়াকলাপে বড় প্রভাব পড়বে।
রমজানকে মুসলিমরা দান-খয়রাতের জন্য বিশেষ সুযোগ হিসেবে ব্যবহার করেন। মুসলিমদের বিশ্বাস, এ মাসে দান করা হলে অন্য মাসের চেয়ে বেশি সওয়াব পাওয়া যাবে। এবার মহামারির কারণে অনেকের চাকরি নেই, ব্যবসায় ক্ষতি হয়েছে, সবক্ষেত্রে এখন মন্দার হাওয়া। এ কারণে দান-খয়রাতে মহামারির প্রভাব প্রত্যক্ষ হবে। অবশ্য, গত বছর এ ধরনের আশঙ্কা থাকলেও যথাযথ পরিমাণে দান আদায় এবং বিতরণ করা সম্ভব হয়েছে বলে জানিয়েছে অনেক সংস্থা। এ মাসটা জাকাত আদায়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। যুক্তরাজ্যভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ‘মুসলিম হ্যান্ডস’ জানিয়েছে, ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালে তাদের জাকাত সংগ্রহ বেড়েছে।
রমজানের তহবিল সংগ্রহ মুসলিম বিশ্বে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়তা, স্বেচ্ছাসেবী কাজগুলো অব্যাহত রাখা, সঙ্ঘাত ও দুর্যোগপূর্ণ অঞ্চলে খাবার পাঠানো- কাজগুলো রমজানের বিশেষ দানের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। সিরিয়া, লেবানন, ইয়েমেন এবং মিসরের মতো অর্থ-সংকট কিংবা সঙ্ঘাত-আক্রান্ত দেশগুলোর মানুষের জন্য এ মাসের বিশেষ সহায়তা বড় ভূমিকা রাখে।
করোনায় বড় প্রভাব ফেলবে মক্কা ও মদিনা সফরে। এ মাসে ওমরার প্রতি বিশেষ আগ্রহ থাকে মুসলিমদের। গত বছর অনেকে ওমরার জন্য ট্রাভেল এজেন্সিকে টাকা দিয়েও পরে ফেরত নিয়েছিলেন। এ বছর যারা ওমরা করবেন, তাদের কোভিডের টিকা নেওয়ার সুপারিশ করেছে দেশটি। এবার জমজমের পানি আগের মতো সহজলভ্য হবে না। মসজিদের ভেতর খাবার ভাগাভাগিও করা যাবে না। বিতরণও করা যাবে না।
পৃথিবীর অনেক দেশেই রমজানের বিশেষ কিছু রেওয়াজ রয়েছে। এর অন্যতম হলো, পাড়ায়-মহল্লায় বিশেষ যৌথ সঙ্গীতের মাধ্যমে রোজাদারদের জাগিয়ে তোলা। অনেক স্থানে একে ‘কোরাশ’ বলা হয়। কিন্তু এবার তা পালিত হবে বলে মনে হয় না। কারণ, অনেক জায়গায় রাত্রিকালীন কারফিউ কিংবা লকডাউন রয়েছে।
ঈদে করোনার প্রভাব যে জোরেশোরে পড়বে, তা বলা বাহুল্য। ঈদের জামাত আগের মতো সাবলীল হবে না। নামাজের পর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন গভীর করার প্রতীক হিসেবে যে কোলাকুলি করা হয়, তা অনেকে স্বাস্থ্যঝুঁকি হিসেবে নেবেন। নতুন পোশাক, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মিষ্টান্ন গ্রহণ, ঈদ পুনর্মিলনী, আলোকসজ্জা- সবই এবার ব্যাহত হবে করোনার কারণে।
ঈদ শুধু ঈদের দিনে সীমাবদ্ধ থাকে না। ঈদের ছুটিতে সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন। অনেক দিন ধরে এ উদযাপন চলে। পার্ক, দর্শনীয় স্থান, বিনোদনের স্থান, রেস্টুরেন্ট- এ ধরনের জায়গাগুলোতে প্রচুর ভিড় হয়। ঈদ মানেই বাঁধভাঙা আনন্দ, ঘরবন্দি থাকা নয়। সে আনন্দকে কখনও সীমাবদ্ধ করা যায় না। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে এবার ঈদের জাঁকালো আয়োজনে হয়তো বড়সড় ছেদ পড়বে। বিভিন্ন দেশে সরকারি নিষেধাজ্ঞাও আসতে পারে। সঙ্গত কারণে বলা যায়, এবারও হয়তো মুসলিমরা গতবারের মতো নিরানন্দ এবং নীরব একটি ঈদ উদযাপনের অভিজ্ঞতা লাভ করবে।