ইউরোপে দ্রুত বাড়ছে মুসলিমের সংখ্যা


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৬ জুন ২০২১, ১৫:৩১

সারা বিশ্বেই মুসলিমদের সংখ্যা বাড়ছে। তবে খ্রিস্টান-প্রধান ইউরোপে মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটছে নাটকীয়ভাবে। বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ফ্রান্স, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, সুইডেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের জনসংখ্যার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হবে মুসলিম। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে তা হবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূূর্ণ। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলছেন, আগামী শতাব্দীতে ইউরোপের কয়েকটি দেশ হবে মুসলিম-প্রধান।

বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সংখ্যার অনুপাতে ২০৫০ সালে ইউরোপের চেহারাটা কেমন দাঁড়াবে, অভিবাসনের হার বিবেচনায় এর নানা চিত্র দাঁড় করিয়েছে মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টার। তাতে দেখানো হচ্ছে, মুসলিম জনসংখ্যার বিরাট বৃদ্ধি ঘটবে বিভিন্ন দেশে।

যেমন ধরা যাক সুইডেনের কথা। ২০১৬ সালে সুইডেনের মুসলিমদের সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৮ দশমিক ১ শতাংশ। কিন্তু অভিবাসনের উচ্চ হার অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ সুইডেনে মুসলিমরা হবে মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। অর্থাৎ জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। কারণ মুসলিমরা গড়ে ১৩ বছর কম বয়সী এবং তাদের সন্তান জন্মাদানের হারও বেশি। ইউরোপের মুসলিম নারীরা অন্যদের চেয়ে গড়ে একটি সন্তান বেশি জন্মদান করেন।

পিউ রিসার্চ সেন্টার অভিবাসনের বিভিন্ন হার বিবেচনায় নিয়ে ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা সম্পর্কে তিন ধরণের পূর্বাভাস দিয়েছে। এতে বলা হচ্ছে, অভিবাসন যদি এখনই শূণ্যে নামিয়ে আনা হয় তারপরও ইউরোপের মুসলিম জনসংখ্যা বর্তমানের ৪ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৭ দশমিক ৪ শতাংশে। আর যদি অভিবাসনের উচ্চ হার অব্যাহত থাকে, তাহলে মুসলিম জনসংখ্যা হবে ১৪ শতাংশের বেশি।

কয়েক বছল আগে পিউ রিসার্চ সেন্টার এই গবেষণাটি চালায় মোট তিরিশটি দেশের ওপর। এর মধ্যে ২৮টি ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। অন্য দুটি দেশ হচ্ছে নরওয়ে এবং সুইটজারল্যান্ড। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য অবশ্য সম্প্রতি ইইউ থেকে বেরিয়ে গেছে।

২০১৬ সালের তথ্য বিবেচনায় নিলে ইউরোপের এই ৩০টি দেশের মুসলিম জনসংখ্যা ছিল ২ কোটি ৫৭ লক্ষ। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর মাত্র ৬ বছর আগেও এ দেশগুলোর মুসলিম জনসংখ্যা ছিল এক কোটি ৯৫ লাখ যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। ৬ বছরে বেড়েছে ৬০ লাখের বেশি মুসলিম।

জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে বেশি মুসলিম আছে ফ্রান্সে। দেশটিতে বাস করে ৫০ লাখ মুসলিম। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলিমরা হচ্ছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। ইউরোপের এই ৩০টি দেশের মধ্যে মুসলিমরা জনসংখ্যা অনুপাতে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যায় আছে জার্মানিতে। সেখানে মোট জনসংখ্যার ৬ দশমিক ১ শতাংশ মুসলিম। মোট মুসলিমের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। ব্রিটেনে মোট জনসংখ্যার অনুপাতে মুসলমানদের সংখ্যা জার্মানির তুলনায় বেশি ৬ দশমিক ৩ শতাংশ। ব্রিটেনে মুসলমানদের সংখ্যা ৪১ লাখের বেশি। এছাড়া ইউরোপে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় মুসলিম আছে নেদারল্যান্ডস, ইটালি, স্পেন এবং সুইডেনে।

সামনের দশকগুলোতে ইউরোপের মুসলিম জনসংখ্যা সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতে গিয়ে পিউ রিসার্চ সেন্টার তিন ধরণের অভিবাসন পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়েছে: একেবারে শূণ্য বা জিরো ইমিগ্রেশন, মধ্যম এবং উচ্চ হারে অভিবাসন।

ইউরোপে অভিবাসন যদি এখনই একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয়, তারপরও ২০৫০ সাল নাগাদ ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়াবে সাড়ে তিন কোটিতে। যা মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইউরোপের দেশগুলো অভিবাসনের ক্ষেত্রে অনেক কঠোর হলেও এটা বন্ধ করার কোনো কথা উঠছে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ইউরোপ অভিবাসীদের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য।

যদি মধ্যম হারে অভিবাসন চলতে থাকে, তাহলে ইউরোপে মুসলিমদের সংখ্যা ২০৫০ সাল নাগাদ সাড়ে পাঁচ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। এর মধ্যে ব্রিটেনেই মুসলিমদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হবে। এই সংখ্যা দাড়াবে এক কোটি ৩০ লাখে।

আর উচ্চ হারে অভিবাসন ঘটলে ২০৫০ সালে ইউরোপে মুসলিমদের সংখ্যা হবে সাড়ে সাত কোটি। জার্মানি হবে ইউরোপের সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। জার্মানির মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ হবে মুসলিম। মুসলিমদের মোট সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় এক কোটি ৭৫ লাখে।

তবে অভিবাসনের গতিপ্রকৃতি যাই হোক না কেন ইউরোপের মুসলিম জনসংখ্যা বাড়বেই। অন্যদিকে অমুসলিমদের সংখ্যাও কমবেই। ইউরোপে অভিবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মুসলিম। তারপর রয়েছে খ্রিস্টানরা। তবে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়লেও অভিবাসী গ্রহণ না করলে সার্বিকভাবে ইউরোপের জনসংখ্যা কমতে থাকবে।

ইউরোপের মুসলিমদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বৈচিত্র। তাদের মধ্যে ইউরোপে জন্ম নেওয়া মুসলিমরা যেমন আছেন, তেমনি আছেন অন্য দেশ থেকে আসা মুসলিমরাও। তাদের মধ্যে সুন্নী, শিয়া ও সুফিবাদে বিশ্বাসী মুসলিমরাও আছেন।

বেশি সন্তান জন্মদানের কারনে মুসলিম জনসংখ্যা এমনিতেই বাড়ছে। অন্যদিকে ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপে মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ার বড় কারণ ছিল অভিবাসন। এ সময় অভিবাসনের কারণে জনসংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকহারে। এ সময় প্রায় ৩৫ লাখ মুসলিম ইউরোপে অভিবাসী হয়। আবার ইসলাম থেকে অন্য ধর্ম গ্রহণ করার প্রবণতাও খুবই কম। ইউরোপে মুসলিম অভিবাসীদের একটি বড় অংশই গিয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া থেকে।

তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মরক্কো ও ইরান থেকেও প্রচুর মুসলিম এ সময়ে ইউরোপ থিতু হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ছিল ১০ লাখের মত। তারা মূলত অভিবাসী হিসেবে গিয়েছে, শরণার্থী হিসেবে নয়। আবার ভারত থেকে যত লোক ইউরোপে অভিবাসী হয়েছে তাদের মধ্যেও ১৫ শতাংশই মুসলিম।

ইউরোপে মুসলিমদের জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে তেমনি কমছে অমুসলিমদের সংখ্যা। এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারা অব্যাহত থাকলে ইউরোপের কয়েকটি দেশে এক সময় মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। গবেষক পিয়ের রোস্টান ও অ্যালেকজান্ড্রা রোস্টান পিউ রিসার্চের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে দেখিয়েছেন যে আগামী ২০০ বছরের মধ্যে ইউরোপের অনেক দেশই হবে মুসলিম প্রধান।

মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ২০০ বছরে ইউরোপের অন্তত ৬টি দেশ মুসলিম প্রধান হয়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। এর মধ্যে বেলজিয়াম মুসলিম প্রধান হবে ২১৭৫ সালে। বুলগেরিয়া হবে ২১৬০ সালে, সাইপ্রাস ২১৭৫ সালে, ফ্রান্স ২১৬৫ সালে , সুইডেন ২১৭০ সালে এবং যুক্তরাজ্য ২১৯৫ সালে মুসলিম প্রধান দেশে পরিণত হবে।

মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির এ ধারা চলতে থাকলে আগামী ২০০ বছরে আরও অনেক দেশই মুসলিমপ্রধান হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। মুসলিম অভিবাসী গ্রহণের হার যদি মাঝারি ধরনের হয় তাতেও ইউরোপের ১৩টি দেশ ২০৮৫ থেকে ২২১৫ সালের মধ্যে মুসলিমপ্রধান দেশে পরিণত হবে বলে গবেষকরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন। বাকি ১৭টি দেশও পরবর্তী ২০০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২৪০০ সালের মধ্যে মুসলিমপ্রধান হবে বলে পূর্বাভাস দিচ্ছেন গবেষক পিয়ের রোস্টান ও অ্যালেকজান্ড্রা রোস্টান। এটা ঘটলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বদলে যাবে ইউরোপ।

২০১৫ সালে পিউ রিসার্চের গবেষণায় বলা হয়, মুসলিমদের সংখ্যা বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। বর্তমানে বিশ্বে সার্বিকভাবে জনসংখ্যা যে হারে বাড়ছে সেই তুলনায় বেশি বাড়ছে মুসলিমরা। ২০১০ সালের হিসেবে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ২২০ কোটি খ্রিস্টান আর মুসলিমদের সংখ্যা ১৬০ কোটি। ২০৫০ সালে বিশ্বে মুসলিম ও খ্রিস্টানের সংখ্যা প্রায় সমান সমান হবে। চলতি শতাব্দীর শেষ দিকে মুসলিম জনসংখ্যা খ্রিস্টানদের চেয়ে বেশি হবে।

২০৫০ সালে ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা হবে ৩১ কোটি। তখন সবচেয়ে বেশি মুসলমানের বাস হবে কয়েক শতাব্দী মুসলিম শাসনে থাকা ভারতে। ভারতে হিন্দু ও খ্রিস্টানদের তুলনায় মুসলিম নারীদের সন্তান জন্মদানের হার বেশি। ২০৫০ সালে আমেরিকার মুসলিম জনসংখ্যা হবে মোট জনসংখ্যার ২ শতাংশের বেশি। বর্তমানে আমেরিকার জনসংখ্যার এক ভাগ মুসলিম। ২০১৫ সালের হিসেবে দেশটিতে ৩৩ লাখের বেশি মুসলিমের বাস।

তবে একথা মনে রাখতে হবে, ইউরোপ ও আমেরিকায় মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকাতে সেখানে অনেক ইসলাম বিরোধী রাজনৈতিক দলের উত্থান হচ্ছে। তারা জনপ্রিয়তাও পাচ্ছে। অস্ট্রিয়ায় একটি মুসলিমবিরোধী দল তো ক্ষমতায়ই চলে গেছে। তাই সামনের দিনগুলোতে অবস্থা কী দাঁড়ায় তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।