তালেবান শাসনে চার দিন

-

  • হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী
  • ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৭:৫৪

মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার ১৬ বছর পরও নিশ্চিহ্ন হয়নি আফগানিস্তানের তালেবান। সম্প্রতি তারা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নগর দখলে নিয়েছে। তাদের শাসনাধীন হেলমান্দ প্রদেশের জীবনযাত্রা দেখতে তারা আমন্ত্রণ জানায় বিবিসির সাংবাদিক আউলিয়া আতরাফিকে। সেই অভিজ্ঞতার বাংলা রূপান্তর করেছেন হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী

তালেবান-শাসিত অঞ্চলে আমাদের সফরটি নিশ্চিত করতে আমাদের কয়েক মাস সময় লেগেছে। বহু বছরের মধ্যে কোনো আন্তর্জাতিক মিডিয়ার এ ধরনের ‘সাফল্য’ এটাই প্রথম। আমাদের সাথে ছিল একটি তালেবান মিডিয়া টিম। আমরা কী দেখবো-না-দেখবো, তারাই ঠিক করে দিত।
গত মে মাসের এক দুপুরে আমরা কাবুল-হেরাত হাইওয়ে ধরে চলছিলাম কান্দাহারের পথে। আমাদের পেছন পেছন চলছিল একটি মোটর বাইক। অল্প বয়স্ক একটি ছেলেই চালাচ্ছিল। সরকারি বাহিনীর একটি চেকপোস্টের কাছাকাছি আসতেই ছেলেটি হঠাৎ হাইওয়ে ছেড়ে নেমে গেল। এখানে-ওখানে কিছু ঘরবাড়ি, এর মাঝখান দিয়েই চলছিল ছেলেটি। কিছু দূর গিয়ে সে আমাদের তুলে দিল দু’জন তালেবানরক্ষীর হাতে। ওরা ওখানে অস্থায়ী ঘাঁটি বানিয়ে বসেছিল। দুই রক্ষীর একজন আমাদের সাথে গাড়িতে এসে বসল, অপরজন মোটরবাইকে চড়ে আমাদেরকে জানবুলাই এলাকার পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। সেখানে আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন মোল্লা তাকি; তিনি তালেবান স্পেশাল ফোর্সের প্রধান। তার সাথে ছিল একদল লোক। প্রত্যেকেই অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত।

সানজিন শহরে
আমরা যখন সানজিন শহরে পৌঁছাই, তখন রাত নেমে গেছে। গন্তব্যে গিয়ে দেখতে পাই, চার দিকে কাদায় ভরা এক প্রাঙ্গণে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে আছে জনাতিরিশেক মানুষ। তাদের মাথায় পাগড়ি। আকাশে চাঁদ উঠেছে। তাতে ওদের সবার মুখে পাগড়ির ছায়া পড়ে মুখগুলোকে কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে।
এরাই হচ্ছে তালেবানের স্পেশাল ফোর্স- রেড ইউনিট। লোকগুলো চুপচাপ বসে তাদের কমান্ডার মোল্লা তাকির যুদ্ধের গল্প শুনছিল। তার পাশে রাখা ছিল এম-৪ মেশিনগান। এই মেশিনগানে অন্ধকারেও লক্ষ্যবস্তু দেখার সুবিধা (নাইট ভিশন স্কোপ) আছে। বলা হয়, অপেক্ষাকৃত সেকেলে অস্ত্রে সজ্জিত সরকারি বাহিনীকে হটিয়ে তালেবান যে হেলমান্দ প্রদেশের ৮৫ ভাগ এলাকা দখল করতে পেরেছে, তার পেছনে এই মেশিনগানের বিরাট অবদান রয়েছে।
কিন্তু এসব বিজয় তারিবান নেতৃত্বকে এক অভাবিত চ্যালেঞ্জের মুখেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যেমন, এখন তারা যেসব লোককে শাসন করছে, ওরা এক দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারের চাকরি করেছে। এ সময় তারা স্কুল, হাসপাতাল, উন্নয়ন- এসবের সাথে খাপ খেয়ে গেছে। তালেবান হচ্ছে এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তারা ক্ষমতায় বসেই ‘শরীয়া আইনের’ নামে এক নিষ্ঠুর শাসন চালু করে- প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর, হাত কাটা, নারীদের ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা ইত্যাদি। তারা পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং নারীদের বোরকা পরা বাধ্যতামূলক করে। টেলিভিশন, গানবাজনা ও সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ করা হয়। ক্ষমতায় থাকাকালে এবং ক্ষমতা হারানোর পরও তারা আশ্রয় দেয় আলকায়েদা নেতাদের। আর নির্বিচার রক্তপাত তো ছিলই। সেটা এখনো চলছে।
আগেই বলেছি, আমাদের সাথে ছিল তালেবান মিডিয়া টিম। তারাই ঠিক করত আমরা কী দেখব-না-দেখবো। আমরা আফিম ক্ষেতের ছবি তুলতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না। অথচ আফগানিস্তান মানেই আফিম। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ আফিম উৎপাদিত হয় এই দেশে। আর আফিম বেচার টাকায় চলে তালেবান।
বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম তালেবান মিডিয়া টিমের প্রধান আসাদ আফগানের কাছে। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘টাকার জন্য। নইলে আফিমকে আপনারা যেমন ঘৃণা করেন, আমরাও তেমনই করি।’
বোঝা গেল, মাদক বিক্রির টাকা তালেবানের খুব কাজে লাগে। এই টাকায় তারা অস্ত্র কেনে, যুদ্ধের খরচ মেটায়।
তালেবান শাসন দেখতে আমরা প্রথম যাই সানজিনের বাজারে। সানজিন এলাকাটির নিয়ন্ত্রণ কব্জা করতে এক দশক ধরে ভয়াবহ সব যুদ্ধ চলেছে। জীবন দিয়েছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের শত শত সৈন্য। অবশেষে চলতি বছরের (২০১৭) মার্চ মাসে তালেবানের দখলে আসে সানজিন।
পুরনো সানজিন বাজারটি যুদ্ধে গুঁড়িয়ে গেছে। এখন গড়ে উঠেছে অস্থায়ী দোকানপাট। দেখলে মনে হয় যেন তাঁবুর দুনিয়া। তারই মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলছিলাম আমরা। একটি খাবারের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছিল দু’জন লোক। এদের একজন ওই দোকানেরই মালিক হাজী সাইফুল্লাহ। তিনি চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমি কি পড়তে পারি যে, এই বিস্কুটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে সেটা বুঝব?’
হাজী সাইফুল্লাহ যার সাথে ঝগড়া করছিলেন তিনি হলেন নূর মোহাম্মদ; সানজিনের তালেবান মেয়র। তিনি হাজী সাইফুল্লাহকে তিন দিনের কারাদণ্ড ও জরিমানার নির্দেশ দিয়ে ঢুকলেন এক পেট্রলের দোকানে। তেলের কনটেইনার খুলে দেখলেন ভেজাল তেল বা ওজনে কম আছে কি না। এরপর মেয়র ধরলেন কয়েকজন লোককে। ওই লোকগুলো বলছে তারা ডাক্তার, কিন্তু মেয়রের সন্দেহ, ওরা ভুয়া ডাক্তার। যা হোক, তিনি সত্যাসত্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করলেন।

তালেবান রাজধানীতে
এরপর আমরা চললাম মুসা ক্বালায়। এটি হচ্ছে তালেবানের ডি ফ্যাক্টো রাজধানী। মুসা ক্বালা আফিম ব্যবসার জন্য ‘বিখ্যাত’। তবে এটাও ঠিক যে, এটি হচ্ছে ওই জেলার বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র। আফগান-পাকিস্তান সীমান্ত এলাকা থেকেও ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন। কী মেলে না এই বাজারে? মোটর বাইক থেকে গরু-ভেড়া, আইসক্রিম থেকে অস্ত্রশস্ত্র- সবই পাওয়া যায়। একে-৪৭ রাইফেলের বুলেট মেলে প্রতিটি ২৫ সেন্ট দামে। রাশিয়ান মেশিনগানের বুলেট পাওয়া যায় প্রতিটি ৪০ সেন্ট দামে। তবে স্থানীয় এক দোকানি জানালেন, যদি সরকারি বাহিনীর কাছ থেকে অনেক বুলেট বাগানো যায়, তবে দাম ১৫ সেন্ট পর্যন্ত নেমে আসে।
মোটের ওপর তালেবান যে মুসা ক্বালায় স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও ব্যবসায়িক মানের দিকে নজর দিয়েছে, তা বেশ চমকপ্রদ। তবে মুসা ক্বালায় আমাদের জন্য আরো ‘চমক’ অপেক্ষা করছিল। চমকটি হলো, মুসা ক্বালা তালেবানের ‘রাজধানী’ হলে কী হবে, এর স্কুল ও হাসপাতালগুলো চলে আফগান সরকারের টাকায়। মুসা ক্বালায় সরকারি শিক্ষা বিভাগের প্রধান আবদুল রহিম বলেন, ‘সম্প্রতি সরকার আমাদের স্কুলগুলো পরিদর্শন করে গেছে। এসব স্কুল সরকারের নিবন্ধিত। আমাদের বেতন এক বছর বকেয়া ছিল, পরে সরকার সেটা দিয়ে দিয়েছে। সরকারি পরিদর্শকদের কোনো রকম বাধা দেয়নি তালেবান। সব ঠিকঠাকমতো চলছে।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের যা কিছু লাগে, সরকার সবই দেয়। আমরা সরকারি সিলেবাস অনুসরণ করি। তালেবান এ নিয়ে কিছু বলে না।’
তবে আবদুল রহিম ‘সব কিছু ঠিকঠাকমতো চলছে’ দাবি করলেও ব্যাপারটা আসলে তেমন নয়। সারা আফগানিস্তানে স্কুলশিক্ষার্থীদের ৪০ ভাগ হলো ছাত্রী। কিন্তু তালেবান রাজধানীতে ১২ বছরের বেশি বয়সী কোনো মেয়েকেই লেখাপড়া করতে দেয়া হয় না। অবশ্য এ জন্য শুধু তালেবানকে দোষ দেয়া যায় না, তালেবান আমলের আগে থেকেই এ অবস্থা চলে আসছে। কারণ, এটি মহারক্ষণশীল একটি এলাকা।
ছেলে শিক্ষার্থীদেরও সমস্যা আছে। লেখাপড়ার অনেক প্রয়োজনীয় উপাদানই তাদের নেই। দাদুল হক নামে এক ছাত্র বলে, ‘আমাদের স্কুলটি যেভাবে চলছে, ঠিক আছে। বিশেষ করে নিরাপত্তার দিকটা। কিন্তু অন্য অনেক সমস্যা আছে। যেমন ধরেন, আমাদের যথেষ্ট বই নেই। কারো হয়তো অঙ্ক বই নেই, কারো বা রসায়ন। সব বই আছে, এ রকম ছাত্র খুব কমই আছে।’
তা সত্ত্বেও একটা বিষয় আমাকে খুব অবাক করেছে, তা হলো, তালেবান তাদের পূর্ববর্তী শাসনকালের তুলনায় এবার শিক্ষা বিষয়ে, অন্তত ছেলেদের ব্যাপারে হলেও, খানিকটা উদার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েছে। ২০০১ সালের আগে গ্রামাঞ্চলের খুব কম ছেলেই স্কুলে যেত। কিন্তু সানজিনের বিস্কুটবিক্রেতা হাজী সাইফুল্লাহর মতো অনেক অভিজ্ঞতা আফগান গ্রামবাসীকেও বুঝতে শিখিয়েছে যে, শিক্ষা ও সাক্ষরতা লাগবেই, এ ছাড়া চলে না। আর শিক্ষা কাউকে ধর্মদ্রোহীও করে না। যদিও তাদের পূর্বপুরুষেরা সে রকমই ভাবতেন।
এখন মনে হচ্ছে, তালেবান বুঝতে পেরেছে যে, আধুনিক বিশ্বের সাথে তারা সারা জীবন লড়াই করে পারবে না। কাজেই তাদের কেউ-কেউ নিজস্ব স্টাইলে এর সাথে যোগ দেয়াই ভালো মনে করছে। তালেবানের মিডিয়া সমন্বয়কারী আসাদ আফগানের কথাতেই সেটা পরিষ্কার। তিনি একটি আফগান প্রবাদ শোনালেন, ‘আগুন আমাদের ঘর পুড়িয়ে দিলো, কিন্তু তাতে দেয়ালটা মজবুত হলো’। অর্থাৎ আধুনিকতার কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখাটা যে ভুল ছিল, তালেবান সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছে।
অনেকে বলেছে, তালেবান রাজত্বে স্বাধীনতা কিছুটা খর্ব হয়েছে বটে, তবে তারা যেসব এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে, সেখানে বেড়েছে নিরাপত্তা। গ্রামের দিকের যেসব এলাকায় সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে যুদ্ধ ছিল নিয়মিত ঘটনা, সেখানে এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের নাটকীয় সমৃদ্ধি দেখার মতো। অনেকে বলেছেন, তালেবান দ্রুত বিচার করে। সেখানে ভুলভ্রান্তির অবকাশ বেশি থাকলেও তা আগের সরকারের চেয়ে অনেক ভালো। ওই সময় তো ছিল দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির রমরমা।
আমরা জেলা হাসপাতাল পরিদর্শনে যাই। স্কুলের মতো হাসপাতালেও টাকা দেয় আপগান সরকার, আর চালায় তালেবান। এক লাখ ২০ হাজার মানুষের জন্য এই হাসপাতাল। এখানেও অনেক মৌলিক সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। এই হাসপাতালে একজনও নারী ডাক্তার নেই, নেই কোনো শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ। এই হাসপাতালে বুকের একটা এক্স-রে করানোর সুবিধা পর্যন্ত নেই।
তবে নারীদের জন্য পাশেই একটি আলাদা ব্যবস্থা করেছে তালেবান কর্তৃপক্ষ। নারী কর্মকর্তা-কর্মচারী দিয়েই চালানো হয় ওটি। একজন ডাক্তার বলেন, ‘এই দ্বৈত ব্যবস্থা দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রে একটা ফাঁক তৈরি করেছে এবং দুর্নীতির দরজা খুলে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ছয় মাস ধরে বেতন পাই না। শুধু আমি নই, হাসপাতালের কোনো স্টাফই বেতন পায় না। সরকারের সুপারভাইজাররা এ নিয়ে লিখেন, কিন্তু কোনো কাজ হয় না। আমাদের তিন মাসের ওষুধ দেয়া হয়, কিন্তু তা দিয়ে আমরা দেড় মাসও চালাতে পারি না। কারণ, তালেবানরা মাঝে মধ্যেই আসে আর নিজেদের জন্য ওষুধ নিয়ে যায়।’
তালেবানের স্বাস্থ্যসেবা তত্ত্বাবধায়ক আতাউল্লাহকে বলেছিলাম আমরা একজন নারী নার্সের সাক্ষাৎকার নিতে পারব কি না। তিনি সরাসরি নাকচ করে দিলেন। অথচ মেয়েটির স্বামীর তাতে কোনো আপত্তি নেই। আতাউল্লাহ মেয়েটির স্বামীকে মুখের ওপর বলে দেন, ‘সাক্ষাৎকার দেয়ার অনুমতি দেয়াটা তোমার অধিকার, আর সেটি হতে না দেয়াটা আমার দায়িত্ব।’
কী হতো সাক্ষাৎকারটা নিতে দিলে?
যা হোক, তালেবান রাজত্বে চার দিন অবস্থানকালে আমি নারীদের দেখতে পেয়েছি কেবল ক্লিনিকে এবং তাদের পুরুষ আত্মীয় পরিবৃত হয়েই এসেছেন তারা। এখানকার পুরুষেরা চায় নারীরা থাকবে ঘরের ভেতর এবং দৃষ্টির অন্তরালে। এটা শুধু তালেবানের কারণে নয়, তালেবান যখন ছিল না, তখনো অবস্থা এ রকমই ছিল। তালেবান না থাকলেও অবস্থার খুব বেশি ইতরবিশেষ হবে, তা মোটেই নয়।
তালেবান রাজত্বে চাইলেই সব কিছু করা যায় না। যেমন মুসা ক্বালায় নিরাপত্তা ও ধর্মীয় কারণে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট ব্যবহার নিষিদ্ধ। আমাদের সাথে তালেবানের যে মিডিয়া হ্যান্ডলার রয়েছেন, তিনি ওয়াকিটকির সাহায্যে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
ছবি তোলা ও গানবাজনাও নিষিদ্ধ। এক তরুণ আমাকে জানায়, বোম্বের সিনেমা দেখার কারণে তাকে ৪০টি বেত্রাঘাত করা হয়।
তবে বৈপরীত্যও আছে। যেমন, আমাদেরকে ছবি তোলার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। আর আমরা অনেক বিলবোর্ড দেখেছি, যাতে পশ্চিমা নারীর ছবি দিয়ে ডেন্টাল ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন দেয়া হয়েছে।
ইন্টারনেট নিষিদ্ধ, তবে অনেক ওয়াইফাই হটস্পট আছে, যা থেকে সংযোগ নিয়ে বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করা যায়। আমরা অল্প কিছু মানুষকে দেখেছি, যাদের টেলিভিশনের সাথে ছোট স্যাটেলাইট ডিশের সংযোগ আছে। এর সাহায্যে তারা তুরস্ক ও ভারতের সিনেমা দেখে থাকে। এক তরুণকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘তোমাদের ভয় লাগে না? তালেবানরা যদি জেনে ফেলে?’ তরুণটি জবাব দেয়, ‘আমাদের টিভি ও ওয়াইফাইয়ের কথা ওরা জানে তো। তবে আমার মনে হয় ওরা অপেক্ষা করছে কী হয় দেখার জন্য।’
তালেবান কর্তৃপক্ষ বাচাবাজও বন্ধ করে দিয়েছে। এটা হচ্ছে অল্প বয়সী বালকদের নাচের আসর। নাচ পর্ব শেষে ওই বালকদের ওপর যৌননিগ্রহ চালানো হয়। সমকামিতার ওপরও খড়গহস্ত তালেবান। কিন্তু আইনব্যবস্থায় প্রভাব খাটানো ও দুর্নীতি বন্ধ করতে পারেনি তারা।
পুরো সফরকালে আমরা সজাগ ছিলাম যে তালেবানরা আমাদের সাথে চলাফেরায়, আচার-আচরণে খুবই সতর্ক। তারা চায়, তাদের ব্যাপারে আমাদের মনে যেন একটা ইতিবাচক ইমেজ তৈরি হয়। তাই সানজিন ও মুসা ক্বালা তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওখানকার লোকজনকে সন্তুষ্ট রাখার ওপর তাদের অনেক কিছু নির্ভর করে। আমরা শুনেছি, তালেবান এই দুই শহরে যতোটা ‘উদার’, অন্যত্র তেমন নয়। বরং বেশ গোঁড়া ও কঠোর সেখানে তারা।
মোটের ওপর আধুনিকতার চেহারা ধারণ করাটা তালেবানের জন্য একটা যন্ত্রণাদায়ক দোটানা তৈরি করেছে বলেই মনে হয়। দোটানাটা এমন : যদি আধুনিকতাকে গ্রহণ করো, তবে ক্ষমতা ও ধর্মীয় বাতাবরণ হারাতে হবে আর যদি না করো তবে তুমি হয়ে যাবে এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ।
তালেবান যখন ক্ষমতায় আসে তখন তাদের দুর্বল দিক মনে করা হয় তাদের রাজনৈতিক দর্শনকে কিংবা রাজনৈতিক দর্শন না থাকাকে। কেননা, গোড়া থেকেই তাদের লক্ষ্য নিবদ্ধ ছিল যুদ্ধের ওপর, ফলে রাজনৈতিক ধ্যানধারণা বিকাশের কোনো সুযোগই সেখানে ছিল না। যুদ্ধে তাদের বিজয়ই তাদের সবচেয়ে বড় পরাজয়।
সাদা দাড়িঅলা এক স্কুলশিক্ষক আরো খোলাসা করে বলেন কথাটাকে। তিনি বলেন, ‘তালেবান সব কিছু দেখে যুদ্ধের আয়না দিয়ে। তারা যুদ্ধ করাকেই জীবনের লক্ষ্য ভেবে থাকে।’
আমি তাকে মনে করিয়ে দেই যে, তালেবানের একটি আনুগত্যের সংস্কৃতিও আছে এবং তারা সুশৃঙ্খল। কাজেই তিনি (শিক্ষক) কি মনে করেন না যে ওরা তাদের যুদ্ধপ্রীতিকে রাজনৈতিক শিল্পকলায় রূপান্তরিত করতে পারবে?
আমার কথা শুনে প্রবীণ শিক্ষক মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবলেন, তারপর মাথা নাড়তে থাকলেন। তাতে তার মনের সন্দেহটি ফুটে উঠল। বোঝা গেল, তিনি তেমনটা মনে করেন না।
এক সন্ধ্যায় আমাদের সাথে কথা বলতে এলেন তালেবান নেতা মুসাভির সাহিব। ছোটখাটো মানুষ। মুখে লম্বা দাড়ি। নীল চোখ। তিনি আমাদের খুব করে বোঝাতে লাগলেন, আগের আফগান সরকারের তুলনায় তালেবান শাসন কত বেশি ভালো। কিন্তু আমার মনে হলো, তারা যা করতে চাচ্ছে তা মানবসমাজের জন্য একেবারেই বেমানান।
আমি তাকে বললাম, মানুষের সমাজ হচ্ছে ঝামেলাপূর্ণ, জটিল ও সদা পরিবর্তনশীল। তাহলে একটা সফল সরকার কেন একে একটা নির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর ঢোকানোর চেষ্টা করবে?
মুসাভির সাহিব তার মতে অনড়। তিনি বলেন, ‘আমাদের শাসনব্যবস্থা ঐশীবাণীর ওপর ভিত্তিশীল। এটাই যেকোনো মানবগোষ্ঠীর জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা।’
তিনি আরো বলেন, ‘আফগানরা হচ্ছে মানিয়ে নেয়ার মানুষ। এই দেখুন না, আমরা প্রথম যেবার ক্ষমতায় এলাম, লোকজন দ্রুতই আমাদের মতো পোশাক পরতে শুরু করল। আবার যখন আমেরিকানরা এলো, তখন তারা আমেরিকানদের মতো পোশাক পরতে শুরু করল। কাজেই বুঝুন, আমরা আবার ক্ষমতায় এলে তারা আমাদের মেনে নেবে।’
আমি তাকে বোঝাতেই পারলাম না যে, জনগণ তালেবানের বিরুদ্ধেও যেতে পারে। তার এক জবান, ‘আমরা যা চাইবো ওরা তা-ই করবে।’

ফেরার পালা
এবার ফেরার পালা। আমরা সরকার নিয়ন্ত্রিত এলাকায় চলে এলাম। মনে হলো, এই বিদ্রোহী দলটি (তালেবান) সোজাসরল নয়, বরং অনেক স্ববিরোধিতায় ভরা। ওরা এক দিকে যেমন অনেকটা বদলে গেছে, তেমনি একই সময় নিজেদের অতীতকেও আঁকড়ে আছে। তারা একদিকে যেমন ভাবছে আধুনিক বিশ্বকে গ্রহণ করে নেয়ার কথা, তেমনি নিজেদের শাসনব্যবস্থাকেই ভাবছে সর্বোত্তম।
তালেবান তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় এই দুয়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করছে বলেই মনে হচ্ছে, কিন্তু অন্যত্র তারা বোমা নিক্ষেপ করেই চলেছে। অর্থাৎ বিশেষ ধরনের চরমপন্থী ‘ইসলামি’ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য থেকে তারা একটুও সরে আসেনি এবং তারা এখনো লড়াই করে চলেছে এ জন্য যে তারা নিজেদের বিজয়ী ভাবছে। কিন্তু তালেবান এখন নতুন এক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। তারা যেসব এলাকা শাসন করছে, সেখানকার মানুষ এখন উন্নয়নের স্বাদ পেয়ে গেছে। ৯/১১-এর পর আফগানিস্তান পুনর্গঠন কর্মসূচির আওতায় বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের উন্নয়নকাজ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারিত হয়েছে, বিদ্যুতের আলো পৌঁছেছে। বদলে গেছে মানুষের জীবন। সেই নতুন জীবনের স্বাদ পেতে উন্মুখ এখন সব মানুষ। মানুষের এই বিশাল প্রত্যাশা পূরণের সাধ্য কি তালেবানের আছে?