চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর ও বাংলাদেশ

-

  • আসিফ মাহমুদ
  • ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ২২:২৫


চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের আওতায় চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের সাথে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত করার মধ্যদিয়ে এ অঞ্চলের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক চিত্র বদলে যাচ্ছে। চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের অংশ হিসাবে চীনের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর কুনমিং এবং বঙ্গোপসাগরের মিয়ানমারের কিউকপিউ বন্দরকে সংযুক্ত করে একটি উচ্চ গতির রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু করেছে চীন।


এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্পন্ন হলে ১,৪০০ কিলোমিটার রেলপথ কৌশলগত অর্থনৈতিক করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ হবে। এর মাধ্যমে চীনের আমদানী এবং রপ্তানির বড় অংশ মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দরের মাধ্যমে হবে। যা এখন সরু মালাক্কা প্রনালী ও দক্ষিন চীন সাগরের মাধ্যমে হচ্ছে। শুধু মিয়ানমার নয় কুনমিংয়ের সাথে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের ব্যাপারেও চীন আগ্রহী।


চীনের এই অবকাঠামো নির্মানের পরিকল্পনা এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক চিত্র বদলে দিতে যাচ্ছে। মিয়ানমারের পশ্চিমা উপকূলে এবং চীন এর দক্ষিণাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশ থেকে ইতোমধ্যে গ্যাস ও তেল পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। যা চীনের সাথে মিয়ানমারের কৌশলগতভাবে সামুদ্রিক সমঝোতার অংশ।
কিউকপিই বন্দরকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (সেজেড) তৈরি করা হচ্ছে এবং চীনা সীমান্তের সাথে মিয়ানমারের উপকূল পর্যন্ত সংযুক্ত করার একটি নতুন এক্সপ্রেস ওয়ের পরিকল্পনা রয়েছে।


এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৬০ টিরও বেশি দেশে বিস্তৃত বাণিজ্য-সংযোগ স্থাপনে সড়ক, রেলপথ এবং সমুদ্র পথের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে চীন। চীনের এই প্রকল্পটি বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ(বিআরআই) প্রকল্প নামে পরিচিত। এই প্রকল্প বাস্তবায়নে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এই নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ হচ্ছে চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর। আরেকটি রুট হচ্ছে পাকিস্তানের গোয়াদর বন্দর থেকে চীনের কাশগড় পর্যন্ত সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন। যা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর নামে পরিচিত।


চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর নিয়ে মিয়ানমারে কিছুটা বির্তক সৃষ্টি হয়েছে। দেশটির কয়েকজন আইন প্রনেতা এসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আরো স্বচ্ছতা দাবি করেছিলেন। গত ডিসেম্বরে বেশ কয়েকজন আইন প্রণেতারা নেপিদোতে পার্লামেন্টে অভিযোগ করেন ধীর গতির কারণে ঋন পরিমান বেড়ে যাচ্ছে। যাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋনের ফাদ তৈরি না হয় সে ব্যাপারে সতর্ক করেন। ঋনের শর্তগুলো পর্যালোচনার দাবি করেন।


মিয়ানমার সরকারের পরামর্শদাতার পদে অধিষ্টিত অং সান সু চি এবং তার জাতীয় লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) এর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার এখন চীনের দিকে বেশি ঝুকে পড়েছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা চাপের মধ্যে তিনি তিনি বিআরআই প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেয়ার নীতি গ্রহন করেছেন। রোহিঙ্গা ছাড়াও অন্য জাতি গোষ্টীগুলোর মিয়ানমার সেনাবাহিনী নানা ভাবে নিপীড়ন চালাচ্ছে। সূ চি সরকার সেনা পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে চীনা প্রকল্পগুলো এগিয়ে নেয়ার মাধ্যমে বিশেষ বার্তা দিতে চাইছেন। অথচ এর আগে থেইস সেইন সরকার ৩দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলারের একটি জলবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মানের প্রকল্প স্থগিত করেছিলো। সে সময় মিয়ানমার সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে সর্ম্পক উন্নয়নের চেষ্টা করেছিলেন।


গত বছর সেপ্টেম্বরে ক্ষমতাসীন এনএলডি নেতৃত্বাধীন সরকার চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর চুক্তিতে স্বাক্ষর করে।সু চি এখন চীনের যৌথ উদ্যোগ প্রকল্প বাস্তবায়নে নিযুক্ত ২৫ সদস্যের স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান।


তিনি এবং তার সহকর্মীরা এই বছরের এপ্রিল মাসে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক সহযোগিতার জন্য বিআরআই ফোরামে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেইজিংয়ে ২০১৭ সালের মে মাসে সালে অনুষ্ঠিত প্রথম এই সম্মেলনে ১৩০ টিরও বেশি দেশ এবং ৭০ টি আর্ন্তজাতিক সংস্থার প্রধান এবং প্রতিনিধিরা উপস্থিতি ছিলেন।
গত বছর জুনে সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট পত্রিকার সাক্ষাতকারে মিয়ানমারের মন্ত্রী থাং তুন মিয়ানমারের ম্যান্দোলা শহর থেকে চীনের ইউনান প্রদেশ পর্যন্ত রেলপথ চালুর কথা জানিয়েছিলেন। এ ছাড়া দক্ষিণ চীনের শহর কুনমিং ও দালি পর্যন্ত রেলপথ আধুনিকায়ন করা হচ্ছে। ৩২৮ কিলোমিটারের এই রেলপথ আধুনিয়াকায়নে ৬ ঘন্টা থেকে সময় কমে আসবে ২ ঘন্টায়। একই ভাবে দালি থেকে সীমান্ত শহর রুইলি পর্যন্ত রেলপথ সংস্কার করছে মিয়ানমার। রেলপথগুলোর সাথে সমুদ্র বন্দর কিভাবে সংযোগ ঘটবে তা নিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডির কাজ শেষ হয়েছে। চীন কার্যত সমুদ্রবন্দর ঘিরে মিয়ানমারকে আধুনিক রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে যাচ্ছে। যার সাথে সীমান্ত শহরগুলোকে সংযুক্ত করা হচ্ছে। ইউনান প্রদেশের সাথে মিয়ানমারকে সংযুক্ত করার সাথে বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোরের গভীর সংযোগ আছে। বিসিআইএম-ইসি প্রকল্পটি পরিচিত ছিল কুনমিং ইনিশিয়েটিভ বা বিসিআইএম রিজিওনার ইকোনমিক কোঅপারেশান নামে। ১৯৯৯ সালের আগস্টে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে চীন, ভারত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিশেষজ্ঞরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এটা। প্রস্তাবিত বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোরের অধীনে বিসিআইএমের দেশগুলোর ২০টি প্রধান শহরকে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। পশ্চিম বঙ্গের রাজধানী কলকাতা থেকে শুরু হয়েছে এই করিডোর শেষ হবে কুনমিংয়ে। মাঝখানে এর সাথে যুক্ত হবে বাংলাদেশের যশোর, ঢাকা এবং সিলেট; মনিপুরের ইম্ফল, আসামের শিলচর এবং মিয়ানমারের কা লে, মোনিওয়া, মান্ডালে, লাশিও এবং মিউজ।

২০১৩ সালের মার্চে ভারত সফরের সময় এই বিসিআইএম-ইসি’র প্রস্তাব করেন চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং। যৌথ বিবৃতিতে প্রাথমিকভাবে চীন ও ভারত এই করিডোর নির্মাণের প্রস্তাব করে। পরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এর পক্ষে তাদের জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করে।সম্প্রতি সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলের উন্নয়নের স্বার্থে ভারতকে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ সংযুক্ত হওয়ার আহবান জানিয়েছেন। যা গভীর তাৎপর্যপূর্ন।