আকাশে তারা থাকুক আর না-ই থাকুক। সন্ধ্যা নামলে সাগরে শুরু হয় তারাদের ভোজবাজি। নীল আলোয় তারাগুলো জ্বলজ্বল করে সাগরের জলে। ঢেউয়ের পিঠে ভাসে, আছড়ে পড়ে সৈকতে। জ্বলজ্বলে এই সৈকতকে বলা হয় পৃথিবীর স্বর্গ। এখানে রাত নামে বিস্ময় নিয়ে। এই বিস্ময়দ্বীপের নাম ভাধু। মালদ্বীপের ছোট্ট এক দ্বীপ।
জলে ভাসা তারা দেখতে এই দ্বীপে ছুটে যান পর্যটকরা। দ্বীপটি দিনের আলোয় একরকম, রাতে অন্য। এখানে প্রতিটি রাত নামে নীল আলোর ফিনকি ছড়িয়ে, খইয়ের মতো তারা ফুটিয়ে।
তাহলে কি আকাশ থেকে তারা নেমে আসে?
না, একদম না। আকাশের তারা আকাশেই থাকে। আর সাগরের তারা সাগরে।
সাগরে এতো তারা এলো কী করে?
জবাবটা একেবারে সহজ না হলেও, কঠিন নয়। ধরা যাক জোনাকি পোকার কথা। এই পোকারা দিনের আলোয় ঝোপে লুকিয়ে থাকে। রাত নামলেই মিটিমিটি জ্বলে। জোনাকিরা যেভাবে জ্বলে, ভাধু দ্বীপের তারাগুলোও অনেকটা সেভাবেই জ্বলে।
কিন্তু ওখানে তারা এলো কেমন করে?
রহস্য আর কিছুই নয়, ওই তারাগুলো মূলত ছোট এক প্রকারের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদগুলো আনুবীক্ষণিক, যাকে বলা হয় ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন। বিজ্ঞানের ভাষায় এদের ডাকা হয় বায়লুমিনেসেন্ট। এসবের ভেতরে আছে লুসিফেরাস নামের রাসায়নিক উপাদান। ওই উপাদান থেকেই ঠিকরে বেরোয় নীল আলো। আর এই আলো থেকেই ভাদু সৈকত জ্বলে উঠে বিস্ময় খেলায়।
ভাধু ছোট্ট দ্বীপ। এখানে স্থানীয় ও প্রবাসী মিলিয়ে সাড়ে পাঁচশো লোকের বাস। যেতে হলে রাজধানী মালে থেকে ১৯৪ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। দ্বীপের দৈর্ঘ্য মাত্র ১.৪ কিলোমিটার। প্রস্থ্য ০.৪ কিলোমিটার।
দেশটিতে আছে আরো অসংখ্য দ্বীপ। ভারত মহাসাগরের এসব দ্বীপ নিয়েই মালদ্বীপ। দেশটিতে আছে ২৬টি লেগুনঘেরা প্রবালদ্বীপ। এগুলোকে বলা হয় অ্যাটোল। আর আছে ১১৯২টি ছোট ছোট দ্বীপ। এগুলোর মধ্যে মাত্র ২০০টি দ্বীপে মানুসের বসতি আছে। বাকিগুলো বাসযোগ্য নয়। তবে সব দ্বীপেই আছে ছোট ছোট সৈকত। হৃদয়দোলানো ঢেউ। সৈকতে সাদা বালি, স্বচ্ছ পানি। আর পানির নিচে সমুদ্রের জীবন।
সাগরতলের রহস্য দেখতেও আপনাকে বেগ পেতে হবে না ওখানে। ডাইভিংয়ের পোশাক পরে ডুব দিতে পারেন নীল পানিতে। সৈকত ছেড়ে এগিয়ে যান কয়েক মিনিট। দেখবেন সাগরের মাছগুলো আপনাকে দেখে কৌতুহলী হয়ে উঠছে। কোনোটা আপনাকে ঠোকর দিচ্ছে। দেখা পাবেন কালো মাথার বড় বড় হাঙ্গরের। ওরা আপনাকে বিরক্ত করবে না। তবে পাশ দিয়ে যখন এই দানবগুলো সাঁতরাবে তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে পারে।
ইচ্ছে হলে চড়তে পারেন ওখানকার ঢেউয়ের পিঠে, যাকে বলা হয় সার্ফিং। একটি বোর্ড নিয়ে ঝাঁপ দিতে পারেন নীল জলে। এর জন্য আপনাকে যেতে হবে দেশটির উত্তরের অ্যাটোলগুলোতে। ওই এলাকায় সার্ফিংয়ের জন্য আলাদা রিসোর্ট রয়েছে। ওখানে আপনি চড়বেন ঢেউয়ের পিঠে, আপনাকে দেখে এগিয়ে আসতে পারে নীল জলের ডলফিন।
মালদ্বীপ ভ্রমণ মানেই রিসোর্ট। একটু আরাম করে ঘুরতে চাইলে আপনাকে রিসোর্টনির্ভর হতে হবে। এ কারণেই মালদ্বীপকে ডাকা হয় ‘হানিমুনের দেশ’। ওখানে দ্বীপে দ্বীপে ব্যয়বহুল রিসোর্ট তৈরি করা আছে। ওগুলোতে থাকা যায়। আবার কিছু রিসোর্টে ডে ট্রিপও দেওয়া যায়। যাওয়ার জন্য আছে স্পিডবোট, সি প্লেন। রিসোর্ট বুক করলেই স্পিডবোট সি প্লেনগুলো আপনাকে নিতে আসবে। এগুলোর জন্য ভাড়াও গুনতে হয় অনেক।
মালদ্বীপের দ্বীপগুলো আগে যেমন ছিলো, এখন তেমনটা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাল্টে যাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে গোটা পৃথিবী। এখন মালদ্বীপের স্বচ্ছ জলে ভাসতে দেখা যায় প্লাস্টিকের জঞ্জাল। যেগুলো সাগরকে দূষিত করছে। সাগরতলের প্রাণকে হুমকি দিচ্ছে।
আশার কথা হলো, বিষয়টি নিয়ে সচেতন হচ্ছেন স্থানীয়রা। কারণ তাদের আয়ের বড় অংশ আসে পর্যটন থেকে। সুতরাং এই ‘ভ’স্বর্গ’কে ‘স্বর্গে’র মতোই রাখতে হবে। স্থানীয়রা এখন প্লাস্টিক রিসাইকেল করতে শিখে গেছে। ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক অন্য কাজে লাগানো হয় ওখানে। সাগর থেকে প্লাস্টিক ছেঁকে তোলা হয়। ব্যবহার করা হয় নতুন কিছুতে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় এই দেশের বাসিন্দাদের তৎপর থাকাটাই স্বাভাবিক। কারণ এটি পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু দেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে সর্বোচ্চ উচ্চতা মাত্র দুই দশমিক তিন মিটার এবং গড় উচ্চতা মাত্র এক দশমিক পাঁচ মিটার।
মালদ্বীপের অর্থনীতির বড় একটা অংশ নির্ভর করে মাছ ধরার ওপর। তাই এই দ্বীপপুঞ্জকে বলা হয় ‘জেলেদের দেশ’। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার লোকেরা জেলে ছিলেন। জেলেদের জালে বেশি ধরা পড়ে টুনা মাছ। ওখান থেকে টুনা মাছের শুটকি সারা পৃথিবীতে রফতানি হয়।
মালদ্বীপ বিখ্যাত নারিকেল গাছের জন্য। ওখানকার নারিকেলের ছোবড়ার দড়ির তুলনা হয় না। জাহাজ ভর্তি করে দড়িগুলো নিয়ে যায় বিদেশিরা। স্থানীয়রা জাহাজ ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত।
দেশটির বড় শিল্প পর্যটন, যা জিডিপির ২৮ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার ৬০ শতাংশই আসে পর্যটন থেকে।
দ্বীপদেশে চাষের জমির অভাব। তাই দেশটির অর্থনীতিতে কৃষির তেমন ভ’মিকা নেই। তাছাড়া যেটুকু জমি আছে, সেগুলোও করে-কেটে খাওয়ার মতো নিজেদের লোক নেই। খাবার আমদানি করেই পেট ভরতে হয় তাদের।
আর শিল্প’র মধ্যে দেশটিতে রয়েছে গার্মেন্টস, নৌকা বানানো এবং হস্তশিল্প।
দেশটিতে জনসংখ্যার সবচেয়ে বড় ঘনত্ব রাজধানী দ্বীপ মালেতে। পানীয় জল এবং আবাদী জমির সীমাবদ্ধতা আছে এখানে। পাশাপাশি জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় সমস্যার মুখোমুখি হতে হয় ওখানে।
একটি ধারণা রয়েছে রাজধানী ‘মালে’র নামেই হয়েছে দেশের নাম। ‘মালদ্বীপ’ শব্দটি সম্ভবত ‘মালে দিভেহি রাজ্য’ থেকে উদ্ভ’ত। এর অর্থ হলো ‘মালে অধিকৃত দ্বীপরাষ্ট্র।’ কেউ কেউ বলেন সংস্কৃত ভাষায় ‘মালা দ্বীপ’ থেকে ‘মালদ্বীপ’ এসেছে। ‘মালা দ্বীপ’ অর্থ দ্বীপের মালা। অপর একটি মতবাদ হলো তামিল ভাষায় ‘মালা তিভু’ অর্থ দ্বীপমাল্য হতে মালদ্বীপ নামটি উদ্ভূত।
প্রাচীন শ্রীলঙ্কার একটি বইয়ে এই দ্বীপপুঞ্জকে ‘মহিলা দ্বীপ’ বলা হয়েছে। কিন্তু ‘মহিলা দ্বীপ’ কেন?, এ ব্যাপারে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হয় তৃতীয় খৃস্টাব্দে অর্থাৎ স¤্রাট অশোকের সময় কয়েকজন বৌদ্ধ ভিক্ষু গিয়েছিলেন এই ‘মহিলা দ্বীপে’। এর পর দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলেন এমক কিছু লোক গিয়ে ওখানে বসতি গড়েন। পরে সিংহলীরা ওই দ্বীপপুঞ্জে যান। দ্বাদশ শতকে আসেন মুসলমানরা। এর পর থেকে মুসলিম সংস্কৃতিতেই চলছে দেশটি। ১১৫৩ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত ৮০০ বছরে মোট ৯২ জন সুলতান দেশটি শাসন করেন।
১৫০৭ সালে পর্তুগীজ পর্যটক দম লোরেনকো দে আলামেইদা মালদ্বীপে পৌঁছান। সে সময় পশ্চিম ভারতের গোয়ায় ছিল পর্তুগীজদের বাণিজ্য কুঠি। তখন পর্তুগীজরা জোর করে মালদ্বীপ থেকে কর আদায় করত।
১৫৭৩ সালে মালদ্বীপের সুলতান সুলতান থাকুরুফানি আল-আযম পর্তুগিজদের বহিষ্কার করেন। তার পর থেকে শুরু হয় নতুন যুগ। গড়ে উঠে দেশটির সামরিক বাহিনী। কিন্তু বৃটিশদের সঙ্গে পেরে উঠেননি সুলতান। ১৮১৫ সালে বৃটিশরা শ্রীলঙ্কাকে আয়ত্বে নেয়। পরে মালদ্বীপকেও অধিকার করে।
১৯৫৩ সালে দেশটিতে সালতানাতের অবসান হয়। মালদ্বীপ হয়ে ওঠে রিপাবলিক। মালদ্বীপের প্রথম রাষ্ট্রপতি ছিলেন আমিন দিদি। তাকে কিছুদিন পরই উৎখাত করা হয়। আবার ফিরে আসে সালতানাত। নতুন সুলতান হন মোহাম্মদ দিদি। তিনি বৃটিশদের সামরিক ঘাঁটি তৈরির অনুমতি দেন। পরে ব্যাপক জনবিক্ষোভ হয়। ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই মালদ্বীপ বৃটিশদের কাছ থেকে পূর্ন স্বাধীনতা লাভ করে।
এখন মালদ্বীপে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারব্যবস্থা। বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম মুহাম্মদ সলিহ। তিনিই সরকারপ্রধান। তিনিই ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন এবং তিনি হচ্ছেন তাদের প্রধান। প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পান। দেশটিতে ৫০ সদস্যের একটি মজলিসে সুরা আছে। এদের মেয়াদও পাঁচ বছর। এই ৫০ সদস্যের মধ্যে আটজন প্রেসিডেন্ট কর্তৃক মনোনীত হন।
মালদ্বীপে প্রথম রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে ২০০৫ সালে। সাবেক প্রেসিডেন্ট মামুন আবদুল গাইউম ‘দ্য মালদ্বীপিয়ান পিপলস পার্টি’ নামে একটি দল বানান। একই বছর আরেকটি রাজনৈতিক দলের উদ্ভব হয় ‘মালদ্বীপিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’ হিসেবে। এভাবেই দেশটিতে বহুদলীয় রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়।
সামুদ্রিক জলসীমাসহ দেশটির মোট আয়তন ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার। কেবল ভ’খন্ডের আয়তন ২৯৮ বর্গকিলোমিটার। ২০০১৭ সালের হিসাবে দেশটিতে মোট জনসংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৩০ জন। এদের সবাই মুসলিম। মুসলমান ছাড়া অন্য কোনো ধর্মের লোকদের দেশটিতে নতুন করে নাগরিকত্ব দেওয়া হয় না।
এখানে ইসলাম এসেছে ১২তম শতাব্দীতে। তখন বাসিন্দাদের ধর্ম ছিলো বৌদ্ধ। মরক্কোর পরিব্রাজক ইবনে বতুতা মালদ্বীপে যান ১১৮৩ সালে। তখন দেশটি ইসলামের উর্বর ভ’মি। এতে তিনি অবাক হয়েছিলেন। কারণ তার জানামতে, কোনো ইসলাম প্রচারক মালদ্বীপে আসেননি।
অবশেষে অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারেন, অনেক দিন আগে আরবের কোনো এক বাণিজ্য জাহাজ তুমুল ঝড়ের মুখে পড়ে। সেই ঝড়ে জাহাজের অভিযাত্রীদের মৃত্যু হয়। একজন মাত্র লোক বেঁচে ছিলেন। তিনি কাঠের টুকরোয় ভেসে থেকে এই দ্বীপে আশ্রয় নেন। তার নাম আবুল বারাকাত। তার আচার-ব্যবহার এবং দৃঢ় ইমানে মুগ্ধ হয়ে দ্বীপপুঞ্জের শাসক ইসলাম গ্রহণ করেন। পরে সাধারণরাও দলে দলে আশ্রয় নেন ইসলামের ছায়ায়।
সেই ছায়া আজও টিকে রয়েছে। এখনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কিছু সদ্ধিান্তে ইসলামী শরিয়াহ অনুসরণ করা হয়।