পাল্টে গেছে দাবার চাল। এখন খাঁচায় বন্দি হয়ে আছে মানুষ। আর অবাধ বিচরণ করছে বন্যরা। নতুন করে জাগছে প্রকৃতি।
পৃথিবী এমন একটা অবস্থায় দাঁড়াবে, ঠিক কিছুদিন আগেও কি ভাবা যেতো? না! যখন চীন দেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলো, তখনও আজকের এই অবস্থা কল্পনা করা যায়নি। অথচ গবেষকরা তখন থেকেই বলে আসছিলেন, ভাইরাসটির পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। কিন্তু এতোটা ভয়ঙ্কর হবে সেটা সম্ভবত সেই গবেষকরাও বিশ্বাস করতে পারেননি। বিশ্বনেতাদের বিশ্বাস করা তো দূরের কথা।
মূলত প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করে বাড়াবাড়িরকমের আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলো মানুষ। এই আত্মবিশ্বাস থেকে তৈরি হয়েছিলো অহমিকা, যা বিশ্ব নেতাদের অন্ধ করে রেখেছিলো।
একের পর এক চাপ তৈরি হচ্ছিলো প্রকৃতির ওপর। পরিবর্তন হচ্ছিলো জলবায়ু। এই পরিবর্তন ঠেকাতে সভা-সেমিনারও করেছেন নেতারা। তৈরি করেছেন বড় বড় বাজেট। কিন্তু ওইসব হইচই ছিলো সেমিনারের গন্ডির ভেতরেই। জলবায়ু ঠিক রাখতে যে বাজেট বরাদ্ধ হয়, তা মানুষেরাই গ্রাস করে নেয়। বৈশ্বিক এই বাড়াবাড়ি নিয়ে সতর্ক করেছিলেন পরিবেশবিদরা। বলছিলেন, প্রকৃতি প্রতিশোধ নেবেই।
হ্যাঁ, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিচ্ছিলো। ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছিলো সবুজ। ধ্বংশ হচ্ছিলো বন। গলে যাচ্ছিলো বরফ। সাগর ভরছিলো প্লাস্টিকে। বনের পশুরা হারিয়ে যাচ্ছিলো। বিলুপ্ত হচ্ছিলো পাখি। এইসব প্রতিশোধে থামানো যাচ্ছিলো না ব্যস্ত পৃথিবীকে।
তাই এমন আচমকা প্রতিশোধ! মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো প্রকৃতি। লড়াই চলছে। আপাতত মানুষ আছে ঘরবন্দি। আর প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে নিজের মতো করে। ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে হারানো অঙ্গ। সারিয়ে নিচ্ছে দগদগে ক্ষত।
ধরা যাক বাংলাদেশের কথাই। সারা পৃথিবীর মতো থমকে আছে এখানকার মানুষও। রাজধানী ঢাকা এখন একেবারেই ফাঁকা। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে মানুষ সময় কাটাচ্ছে ঘরের ভেতর। কিন্তু ব্যস্ততম নগরির সড়কগুলোতে কি ঘটে যাচ্ছে, সেই খবর পাওয়া যাচ্ছে না ঘরে বসে। তবে কয়েকটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ঢাকার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে এখন শালিক উড়ে বেড়ায়। খুঁটে খুঁটে খাবার খায়। হাতিরঝিলে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সবুজ। উড়ে আসছে কছু বিরল পাখিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নীলখেত যাওয়ার সড়কে শুনা যায় পাখিদের কিচিরমিচির। রাজধানীর অট্রালিকায় থাকা মানুষের ঘুম ভাঙে এখন পাখির ডাকে।
পাল্টে গেছে সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের চিত্রও। ওখানে পর্যটকের ঢল নেই। সৈকতজুড়ে সুমসাম নিরব। এই নিরবতায় জাঁকিয়ে বসেছে প্রকৃতি। বালির ওপর নামছে ঢেউ। আবার ফিরে যাচ্ছে। এমন মুগ্ধকরা প্রকৃতিতে সৈকতের কাছে চলে এসেছে ডলফিনেরা। এদের দলে দেখা গেছে একটি গোলাপি রঙের ডলফিনকেও। বিরল এই ডলফিনের ভিডিও ধারণ করেন স্থানীয় একজন। ভিডিওটি দেখে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এটি ইন্দো প্যাসিফিক হাম্পব্যাক ডলফিন। বাংলাদেশের সাগরে যে ছয় ধরনের ডলফিন আছে। সেগুলোর মধ্যে এটিও একটি। ভিডিওতে দেখা ডলফিনটি পূর্ণবয়স্ক। তার সঙ্গে থাকা ডলফিনগুলোও একই প্রজাতির। তবে বয়স কম বলে রঙ বদলায়নি। যখন বয়স বাড়বে ওগুলোর রঙও গোলাপি হয়ে যাবে। ওরা এর আগে কখনো সৈকতের এতোটা কাছে আসেনি।
তবে এখন কেন এলো? কারণ, মানুষ ঘরবন্দি। আর প্রাণিরা মুক্ত।
মানুষ যখন স্বেচ্ছায় ঘরে ঢুকে গেছে, তখন মানুষের তৈরি সড়ক দখল নিতে দেখা গেছে বন্য প্রাণীদের। জাপানের নারা পার্কের কাছে একটি ফাঁকা সড়কে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেছে একপাল হরিণকে। বিরল প্রজাতির এই হরিণেরা নারা পার্কেই থাকে। সেখানে ওদের দেখতে দলে দলে ছুটে আসে পর্যটক। এদের উপদ্রপে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলো প্রাণীগুলো। এখন চলছে করোনা সঙ্কট। হরিণগুলো যারা দেখাশোনা করতেন সেই কর্মীরা আতঙ্কে ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। হরিণদের জন্য এটাই সুযোগ। এরা নেমে এসেছে সড়কে।
এমন আরেক ছবি ধরা পড়েছে পশ্চিম ওকল্যান্ডের একটি স্কুলমাঠে। ফাঁকা মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে বন্য টার্কির দল। থাইল্যান্ডের শপিংমল দাপিয়ে বেড়াচ্ছে হনুমান। ইন্টারনেটে ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিওতে দেখা গেছে ভারতের কেরলে হেলেদুলে সড়ক পার হচ্ছে একটি গন্ধগোকুল। ওই প্রাণিটি সড়ক পার হচ্ছিলো নিয়ম মেনেই, অর্থাৎ জেব্রা ক্রসিং ধরে। গন্ধগোকুল, হনুমান, বন্য টার্কি আর হরিণেরা বন ছেড়ে সড়কে নেমে এলো কেন? কারণ, সড়কে এখন মানুষের ব্যস্ততা নেই। মানুষের ব্যস্ততা না থাকলে সড়কে গাড়ি চলে না। গাড়ি না চললে জ্বালানি পোড়ানোর দরকার হয় না। আর জ্বালানি না পোড়ালে প্রকৃতিও দূষণ হয় না।
পৃথিবীজুড়ে মানুষের এই বন্দীজীবন কমিয়ে আনছে প্রকৃতির দূষণ। সম্প্রতি নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর একটি সুন্দর ছবি তুলেছে। এই ছবিটি তুলনা করা হয় আগের তোলা কোনো ছবির সঙ্গে। পরে দেখানো হয় যানবাহন, কারখানা আর অন্যান্য পাওয়ার হাউজের বিষাক্ত দূষণ এড়িয়ে চীনের আকাশের বিষাক্ত গ্যাসগুলো কেমন উধাও হয়ে গেছে। এখন গোটা পৃথিবীতেই কার্বনডাই অক্সাইডের কারণে তৈরি জীবাশ্ম জ্বালানীর পরিমাণ তলানিতে এসে গেছে।
বিশ্বের দূষণের ৩০ শতাংশ হয় চীন থেকে। ২০১৮ সালে চীন সবচেয়ে বেশি কয়লা ব্যবহার করে। নিজেদের এনার্জির মোট ৫৯ শতাংশ তারা আহরণ করে কয়লা থেকে। এই সবগুলো কাজই পরিবেশকে দূষিত করে। চীন বাদেও হংকং-এর বাতাসে নাইট্রোজেন অক্সাইডের পরিমাণ কমে গেছে। কমেছে অন্যান্য বিষাক্ত উপাদানও। এই শহরটির বেশিরভাগ দূষণের উৎসই ছিল যানবাহন এবং পাওয়ার প্ল্যান্ট। সেগুলোর ব্যবহার কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কমেছে দূষণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, গত এক যুগে হংকং-এর দূষণ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিলো। এসবের বিরুপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছিলো এলাকাটিতে। সময়ের আগেই শিশুর জন্ম, জন্মের পর পর শিশুর মৃত্যুর হার বেড়ে গিয়েছলো অনেক। এতো এতো দূষণের ভেতর বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিলো পৃথিবী। বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষের এই বন্দিসময় বিপর্যস্ত পৃথিবীর প্রতিশোধ। প্রতিশোধের প্রথম দিকে চীনের দূষণ থামিয়ে দেয় প্রকৃতি। এতে চাপমুক্ত হতে থাকে বাতাস। একে একে থামতে থাকে উন্নত দেশগুলোর দূষণও। এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে দূষনের চাপ প্রকৃতিতে নেই বললেই চলে।
চীনের পর ইরান। তারপর ইতালিতে দেখা দেয় করোনার বিপজ্জনক প্রকোপ। সেখানে প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে অসংখ্য মানুষের। একদিকে মৃত্যুর মিছিল। অন্যদিকে চলছে প্রকৃতির জেগে উঠা। ভেনিসের খালগুলো স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ হয়ে উঠছে। পলি সরে গিয়ে চলাচল করছে মাছ।
লকডাউনে থাকা ইতালির সড়কেও দেখা যাচ্ছে বুনো শুয়োর। সার্ডিনিয়ান বন্দরগুলোর কাছাকাছি সাঁতার কাটতে চলে এসেছে ডলফিনের দল। রোমের ফোয়ারাগুলোতে সাঁতার কাটছে হাঁস। নিজেদের মতো ডাকছে, ভাসছে এবং উড়াল দিচ্ছে।
হাঁফ ছাড়ছে প্রকৃতি। ঘরে বন্দি মানুষেরা বাইরের দুনিয়াটাকে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে প্রকৃতির কাছেই। এই সুযোগে বঞ্চনার প্রতিশোধ নিয়ে নিচ্ছে পৃথিবী।
মানুষ বনাম প্রকৃতির এই লড়াইটা যখন শিথিল হয়ে আসবে, তখন প্রকৃতি যতটা সেজেছে, তার উপকারভোগী হবে মানুষই। স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্শাল বার্ক জানিয়েছেন, তারা চীন থেকে রেকর্ড করা বাতাসের মানের যতটা উন্নতির খবর তারা পেয়েছেন, এতে ৫০ বছরের কম বয়সী চার হাজার এবং ৭০ বছরের বেশি চার লাখ ৩৩ হাজার মানুষের জীবন বেঁচে যেতে পারে।
স্পেনে এখন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ প্রকট আকার ধারণ করেছে। এতে রেকর্ড পরিমাণ নেমে এসেছে দূষণ। মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনায় এখন নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের ঘনত্ব নেই বললেনই চলে। মাদ্রিদে পয়লা মার্চ রেকর্ড করা নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইডের গড় স্তর আগের সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৭৫ শতাংশ কম ছিলো। গ্রিনপিসের মুখপাত্র অ্যাড্রিয়ান ফার্নান্দেজের সংগৃহীত তথ্য অনুসারে বার্সেলোনায় এটি ৪৫ শতাংশের বেশি কমেছে। এলাকাগুলোতে যানবাহন চলাচল কমায় দূষণ কমেছে বলে সংস্থাটি মনে করে। গ্রিনপিসের এই হিসাবের সঙ্গে নাসা ও ইউরোপিয় স্পেস এজেন্সির হিসাবও মিলে যায়। আর দূষণ কমেছে কি কমেনি, সেটা কোনোরকম হিসাব না করেই বলে দেওয়া যায়। মানুষ যেখানে খাঁচায় বন্দী, প্রকৃতি সেখানে দূষিত হবে কী করে?
বৈশ্বিক এই সঙ্কট কাটতে কতো সময় লাগবে, সে ব্যাপারে ধারণা দিতে পারছেন না কেউ। তবে আশা করা হচ্ছে, লড়াইয়ে জয় হবে মানুষের। জয় পাওয়ার পর আবার ঘর ছেড়ে মাঠে নামবে মানুষ। তখন প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচতে হবে। শিক্ষা নিতে হবে এই সঙ্কট থেকে। তা না হলে পৃথিবীর আরেক প্রান্ত থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে নতুন বিপদ।