চীন ও ভারত - এশিয়ার এ দুই বড় দেশ এখন পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। এমনিতেও, সেই ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পর থেকেই এ দু' দেশ কিন্তু আর কখনওই একে অপরের পাশে দাঁড়ায়নি, কোনো-না-কোনোভাবে মুখোমুখি অবস্থানেই ছিল। তবে যে কোনো কারণেই হোক, ১৯৭৫ সালের পর চীন ও ভারত তাদের সীমান্তে পরস্পরের প্রতি আর কখনও একটি বুলেটও ছোড়েনি।
অবশেষে বহু বছর পর সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শান্তির সেই সুবাতাস বন্ধ হয়ে গেছে, তার বদলে সেখানে জমে উঠতে শুরু করেছে উত্তেজনার মেঘ। তা দেখে নয়া দিল্লির সামরিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এ উত্তেজনাই শেষ পরিণামে গড়াতে পারে পরিপূর্ণ যুদ্ধের দিকে।
কিন্তু সীমান্ত নিয়ে বিরোধ ও বিতর্ক সত্ত্বেও বহু বছর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পর হঠাৎ কেন জ্বলে উঠতে চলেছে বিরোধের এমন আগুন, যা নিয়ে শঙ্কা করা হচ্ছে আরেকটি পরিপূর্ণ যুদ্ধের? শোনা যাক এ নিয়ে দু' পক্ষের কথা।
ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এ সমস্যার সূত্রপাত মে মাসের গোড়ার দিকে। ওই সময় চীনের সীমান্তরক্ষীরা তিন জায়গা দিয়ে ঢুকে পড়ে বিতর্কিত লাদাখ অঞ্চলে। তারা সেখানে তাঁবু খাটায়, সীমান্ত চৌকি বানায়। এসব কাজ থেকে বিরত হতে তাদের প্রতি বার বার মৌখিকভাবে অনুরোধ জানায় ভারতীয় প্রতিপক্ষ। কিন্তু তাদের কথায় থোড়াই কেয়ার করে চীনের সীমান্তরক্ষীরা। উল্টো তারা তেড়ে আসে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের দিকে, লিপ্ত হয় হাতাহাতিতে। কখনও বা দূর থেকে পাথর ছোঁড়ে। তবে এসব খবর চেপে রাখার চেষ্টা করে চীন। তারা এ ব্যাপারে ঘুণাক্ষরেও কাউকে কিছু জানতে দেয় না।
ভারতীয় কর্মকর্তাদের এসব বক্তব্যের বিপরীতে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এ সমস্যার সূত্রপাত করেছে মূলত ভারতীয়রাই। বিতর্কিত ওই অঞ্চলটিতে ভারতীয়রাই প্রথম সড়ক ও উড়োজাহাজ অবতরণক্ষেত্র তৈরি করে সমস্যার জন্ম দেয়।
ভারতীয় কর্মকর্তা ও পর্যবেক্ষকরা যা বলার বলছেন, আসুন আমরা দেখি ইতিহাস কী বলে, দু'দেশের বর্তমান সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি এবং তার সম্ভাব্য গন্তব্য কোথায়।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে লাদাখের গালওয়ান ভ্যালিতে ভারত ও চীন উভয় দেশের কয়েক হাজার সৈন্য পরস্পরের মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। উভয় দলের মাঝে দূরত্ব মাত্র কয়েক হাজার মিটারের। কেন এ সৈন্য সমাবেশ? চীনের অভিযোগ হলো, ভারত এখান দিয়ে একটি রাস্তা বানাচ্ছে, যা পৌঁছাবে একটি উড়োজাহাজ অবতরণক্ষেত্র পর্যন্ত। স্পষ্টতই এর লক্ষ্য হচ্ছে সীমান্ত সংলগ্ন ওই এলাকার নিয়ন্ত্রণ নেয়া, যে সীমান্তের সীমানাই এখনও পুরোপুরি চিহ্নিত হয়নি।
সীমান্তে বিপুল সৈন্য সমাবেশ ঘটালেও উভয় পক্ষের মধ্যে এখন পর্যন্ত কোনো সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটেনি, তবে পরস্পরকে গালাগালি-হাতাহাতি নিয়মিতই ঘটে চলেছে। ফলে চীনের এক কর্মকর্তাও স্বীকার করেছেন যে, সীমান্ত পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে উভয় পক্ষ তাদের ফ্রন্ট-লাইন মিলিটারি ইউনিটসমূহ এবং নিজ নিজ দূতাবাসের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ বিরোধ নিষ্পত্তিতে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জবাবে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র ঠিক তা-ই বলেছেন, যেমনটি বলেছেন চীনা কর্মকর্তা।
বলা প্রয়োজন যে, এ দুই দেশ ২০১৭ সালেও এ রকম এক বিরোধে জড়িয়ে পড়েছিল এবং ওই সময় অচলাবস্থা ৭৩ দিন স্থায়ী হয়েছিল। ভুটানের দোকলাম এলাকায় চীন ও ভারতের সীমান্ত যেখানে শেষ, সেখানে চীন তার সামরিক উপস্থিতি জোরদার করছে - এমন অভিযোগ তুলে ভারতও ওই অমীমাংসিত সীমান্তে সৈন্যসংখ্যা বাড়াতে থাকলে দু'দেশের উত্তেজনা চরমে ওঠে। দীর্ঘ কূটনৈতিক তৎপরতায় অবশেষে অচলাবস্থা কেটে যায়।
সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে এবং চলমান পরিস্থিতি দেখে বলা যায়, চীন-ভারত সম্পর্ক কখনওই স্বচ্ছন্দ থাকেনি, বরং তাকে পার হতে হয়েছে ও হচ্ছে অনেক চড়াই-উৎরাই। এ দুর্গম পথের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, দু' দেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৫০ সালে। কিন্তু ১৯৬২ সালে দেশ-দু'টি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লে ওই সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায় এবং পরবর্তী কয়েক দশকেও তা আর জোড়া লাগেনি।
এ দু' দেশ একে অপরের বিরুদ্ধে নিজেদের বিস্তীর্ণ এলাকা দখল করে রাখার অভিযোগ করে থাকে। যেমন, চীন দাবি করে যে ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে চীনের ৯০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে রেখেছে। এর মধ্যে আছে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ অরুণাচল প্রদেশও। একই অভিযোগ ভারতেরও রয়েছে চীনের বিরুদ্ধে। ভারতের দাবি, আকসাই চীন মালভূমি এবং পশ্চিম হিমালয় অঞ্চলে ভারতের ৩৮ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা দখল করে রেখেছে চীন, যার ভেতরে আছে লাদাখ এলাকার একাংশও।
শুধু সীমান্তবিরোধ নয়, চীন-ভারত মন কষাকষির আরেকটি বড় কারণ হলেন তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা। ১৯৪৯ সালে তিব্বতে চীনবিরোধী গণঅভ্যূত্থানকালে ইনি ভারতে পালিয়ে এলে ভারত তাকে এবং কয়েক হাজার তিব্বতীকে আশ্রয় দেয়। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় ধর্মসালা শহরে দালাই লামা প্রতিষ্ঠা করেছেন প্রবাসী তিব্বত সরকার। বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না চীন। তারা বলে, তিব্বত হলো চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের স্বাধীনতার দাবি অবাস্তব।
যাহোক, দিন সবসময় এক রকম যায় না। ভারত ও চীন কী বুঝলো কে জানে, ১৯৯৩ সালে তারা একটি চুক্তি করলো। চুক্তিতে বলা হলো, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বা এলএসি বরাবর দু'দেশ শান্তি বজায় রাখবে আর সংঘাত পরিহার করে চলবে। এরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং-এর মধ্যে কয়েকবার বৈঠকসহ দু'দেশের মধ্যে ২০ বারের বেশি আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সমস্যা যে তিমিরে সে-তিমিরেই রয়ে গেছে, সমাধানের কাছেও যায়নি।
কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের প্রতি চীনের সমর্থনও ভারতের একটি বড় মাথাব্যথা। চীন ইতিমধ্যে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মীরের ভেতর দিয়ে একটি সড়ক নির্মাণ করেছে আর নিউক্লিয়ার সাপ্লাইয়ার্স গ্রূপে ভারতের প্রবেশ ঠেকিয়ে রেখেছে এই বলে যে, ভারতকে গ্রূপে নিলে পাকিস্তানকেও নিতে হবে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং-এর পররাষ্ট্র নীতির একটি বড় উদ্যোগ হলো মাল্টি-বিলিয়ন ডলারের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ। ভারত এ উদ্যোগে শরিক হতে অস্বীকার করেছে। আর চীন তার জবাব দিচ্ছে অন্যভাবে। ভারত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এতে চীনের সমর্থন দরকার। চীন এতে কেবল লিপ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ মুখে-মুখেই বলছে সমর্থন দেবে, কাজের বেলায় কিছুই করছে না।
তারপরও যে-বিষয়টি উল্লেখ করার মতো তা হলো, সীমান্তবিরোধ সত্ত্বেও গত দশকে উভয় দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে বৈ কমেনি, যদিও লেনদেনের ভারসাম্য চীনেরই অনুকূলে। খোদ ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী চীনের শতাধিক কম্পানি ভারতে অফিস করেছে, ব্যবসা করছে। এসব কম্পানির অনেকগুলোই চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন। ভারতের মোবাইল ফোনের বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশই দখল করে আছে চীনা প্রতিষ্ঠান সিয়াওমি, হুয়াওয়ে, ভিভো ও অপো। এর বিপরীতে চীনে ভারতের রফতানি পণ্য হলো কেবল তুলা, তামা ও রত্নপাথর।
দু'দেশের বাণিজ্য বাড়তে-বাড়তে ২০১৮ সালে ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উপনীত হয়। আরও বেড়ে ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসেই দাঁড়ায় ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। দু'দেশের মধ্যেকার ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিক ভারসাম্যহীনতা এবং সাম্প্রতিক বিরোধের 'জবাব' দিতে ভারত এখন মুখ ঘোরাচ্ছে ইউরোপীয় বহুজাতিক কম্পানিগুলোর দিকে। চাচ্ছে, ওরাই ভারতে এসে চীনের কোম্পানিগুলোর স্থলাভিষিক্ত হোক।
এভাবেই চলছে ভারত-চীন অম্ল-মধুর সম্পর্ক। এটা শেষ পর্যন্ত গড়ায়, দেখার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী?
প্রতিবেদনটির ভিডিও দেখুন
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে