মোদির আত্মনির্ভর ভারতের স্বপ্ন ধূূলিসাৎ


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৮ জুন ২০২১, ০৯:০৩

সীমান্ত নিয়ে বিরোধ, মহামারি এবং পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়ার পরও ভারতের বাজারে চীনের দখল আরও মজবুত হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে। করোনাকালেই যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে চীন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের বিকল্প নেই ভারতের সামনে। চীন যদি ভারতের ‘বিষফোঁড়া’ হয় তাহলে তার ‘ওষুধ’-ও আবার চীনই।

ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন খাতে ভারতকে আত্মনির্ভর করার ঘোষণা দিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এ নিয়ে ব্যাপক প্রচারণাও চালান তিনি। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা এখন বলছেন, মোদির ওই প্রচারণা ছিল দিবাস্বপ্ন। আদতে চীনের প্রভাব রোধ করা মোদির পক্ষে সম্ভব নয়। গত বছর সীমান্তে নিয়ে ভয়াবহ সংঘাতের পর চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করা হয়েছিল। ভারত সরকার টেলিকমসহ অনেক খাতে চীনকে নিষিদ্ধ করেছিল।

এরপরও চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য বাড়ছে। ২০১৭ সালের পর থেকেই চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য কমে আসছিল। কিন্তু সম্প্রতি সীমান্তে সংঘাতের পর নাটকীয়ভাবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাড়ছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ৫ শতাংশ বেড়েছে বলে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখা যাচ্ছে।

চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বেড়েছে শুধু তাই নয়, চীন যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়েছে। গত অর্থ বছরে দুই চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য ছিল ৮৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আগের বছরের তুলনায় বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের। তবে চীন ভারত থেকে যতটা আমদানি করেছে, রফতানি করেছে তার তিনগুণ।

সর্বশেষ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্য ছিল ৮০ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা বেশি। হিমলায় সীমান্তে দুই দেশের টানটান উত্তেজনার মধ্যেই এ ঘটনা ঘটল। লাদাখের প্রকৃত সীমান্তরেখায় চীন ও ভারতীয় সেনারা সাম্প্রতিক সময়ে বড় ধরনের সংঘাতে জড়িয়েছেন। বিশেষ করে বিপুল সংখ্যক ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর মোদি সরকার চীনা কোম্পানিকে ভারতের জ¦ালানি, রেলওয়ে ও টেলিকম খাতে চীনের বিনিয়োগ নিষিদ্ধকরে। মোদির অনেক মন্ত্রী প্রকাশ্যেই চীনা পণ্য বর্জনের ডাক দেন।

বাণিজ্য ক্ষেত্রে এসব বাগাড়ম্বরের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত বছর দেশটির মোট আমদানি ১৭ শতাংশ কমলেও চীন থেকে পণ্যসামগ্রী আনা বেড়েছে। এতে বোঝা যাচ্ছে চীনের ওপর ভারত কতটা নির্ভরশীল। গত বছর চীন থেকে ভারতের আমদানি ১৩ শতাংশ বেড়েছে। আগের অর্থবছরে এটা বেড়েছিল ১০ শতাংশের কিছুটা বেশি।

মহামারি এবং সীমান্ত উত্তেজনা সত্ত্বেও চীন থেকে ভারতের আমদানি বেড়েছে। ভারত গত বছর মোট যত পণ্য আমদানি করেছে তার সাড়ে ১৬ শতাংশই এসেছে চীন থেকে। আগের বছরও এটা ছিল চৌদ্দ শতাংশের কম। সারা বিশ^ থেকে ভারতের আমদানি কমলেও চীন থেকে তা বেড়েছে তাৎপর্যপূর্ণভাবে।

অবশ্য এ ঘটনায় অনেক বিশ্লেষকই অবাক হননি। তাদেরই একজন নয়া দিল্লির ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ফরেন ট্রেডের অধ্যাপক সুনিথা রাজু। তার মতে গত বছর মোদি আমদানি কমিয়ে আত্মনির্ভর ভারত গঠনের ঘোষণা দিলেও তা এতো রাতারাতি বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। এ ধরনের চিন্তা অলীক কল্পনা। তিনি বলেন, ভারতে অনেক শিল্প আছে যার ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ কাচামাল চীন থেকে আসে। চীন থেকে আমদানি না করলেও অন্য দেশ থেকে এসব কাচামাল আমদানি করতেই হবে। তবে অন্য দেশে চীনের মত কম দামে এসব কাচামাল পাওয়া যায় না।

নয়াদিল্লিভিত্তিক ইন্দো চায়না চেম্বার অফ কমার্সের সভাপতি নরেশ গুপ্ত বলেন, মহামারিতে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে চীনা পণ্যের ওপর ভারত কতটা নির্ভরশীল। ভারতে করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করলে চীন থেকে মাস্ক ও টেস্টিং কিট আমদানি বেড়ে যায়। এরপর মহামারি ভয়াল হলে চীন থেকে আনা হয় মাস্ক ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী তৈরির যন্ত্রপাতি। নরেশ গুপ্ত জানান, বর্তমানে ভারত ৯৯ শতাংশ অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, থার্মাল গান ও অক্সিমিটার চীন থেকে আমদানি করে থাকে। এসব যন্ত্রপাতি তৈরির ক্ষমতা নেই ভারতের। এ অবস্থায় আমদানি ছাড়া বিকল্প নেই। তিনি বলেন, চীনা পণ্য বয়কটের ডাক আসলে রাজনৈতিক নাটক, অন্য কিছু নয়।

বিশ^ বাণিজ্য সংস্থা হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গতবছর চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বেড়ে চললেও বিশ^ বাণিজ্য কিন্তু সংকুচিত হয়েছে। এ সময় মহামারি রোধে লকডাউন ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে বৈশি^ক বাণিজ্য ৫ শতাংশের বেশি সংকুচিত হয়। বিপরীতে চীন ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে।

চীনেও ভারতের রফতানি বেড়েছে। গত বছর চীনে ভারত রফতানি করেছে ২২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আগের বছর এটা ছিল ১৬ বিলিয়ন ডলার। গত বছর ভারতের মোট বৈশি^ক রফতানি কমে যায়। গত বছর ভারত মোট রফতানি করেছে ২৯১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। আগের বছর ভারতের মোট রফতানি আয় ছিচল ৩১৩ বিলিয়ন ডলার। তবে শুধু ভারত নয়, সারা বিশে^ই চীনের রফতানি অস্বাভাবিক বেড়েছে। যেমন গত মে মাসে চীনের রফতানি ৫১ শতাংশ বেড়ে গেছে।

তবে চীনে ভারতের পন্য রফতানি বাড়লেও তাকে সুখবর হিসেবে দেখছেন না ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান এক্সপোর্ট অর্গানাইজেশনের সিইও অজয় সাহা। তিনি বলেন, চীনে রফতানি করা হয়েছে কাচামাল, কোনো দামি পণ্য নয়। এতে বোঝা যাচ্ছে চীনে আমরা কাচামাল রফতানি করছি কারণ আমাদের দেশে এর চাহিদা নেই। অর্থাৎ ভারতের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমছে যা অর্থনৈতিক মন্দার ইঙ্গিতবাহী।

অধ্যাপক সুনিথা রাজু বলেন, আত্মনির্ভর ভারতের বুলি বিভ্রান্তিকর। কারণ চীন থেকে সবচেয়ে সস্তায় পাওয়া যায় বলে আমরা আমদানি করি। হয়তো ৩০ শতাংশ পণ্য আমরা অন্য দেশ থেকেও আমদানি করতে পারি। কিন্তু বাকি ৭০ শতাংশই আনি নানা কারণে। যেমন স্বপ্লতম সময়ের মধ্যে তারা গুনগত মানের পণ্য সরবরাহ করতে পারে।

দেশে উৎপাদন বাড়াতে মোদি সরকার ওষুধ, টেলিকম,টেক্সটাইল, সৌর বিদ্যুৎ ও ইলেকট্রনিক্সহ ১৩ ধরনের পণ্য দেশে উৎপাদনের আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। এতে আগামী ৫ বছরে দেশে অন্তত ৫০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য উৎপাদন বাড়বে বলে সরকার আশা করছে।

যেসব ক্ষেত্রে ভারত কাচামালের ওপর বেশি নির্ভরশীল সেগুলো দেশে উৎপাদনের ওপরই বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। যেমন ওষুধের কাচামাল তৈরির জন্য এপিআই উৎপাদনে মোদি সরকার ৪৭টি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। ভারত ওষুধের কাচামালের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশই চীন থেকে আমদানি করে থাকে।

ভারতের অনেক অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সর্তক করেছেন, ভারত দেশীয় শিল্পের স্বার্থে সংরক্ষণমূলক নীতি অবলম্বন করলে তা হবে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত। ভারত রফতানি উপযোগী পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হলে এমনিতেই দেশ আত্মনির্ভরশীল হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, চীনের সাথে বাণিজ্যে সরকারের অবস্থান কঠোর করার যে কথা বা হচ্ছে, বাস্তবে সেই ক্ষমতা ভারতের নেই। চীনের ওপর নিজের পছন্দমত শর্ত আরোপ করাও সম্ভব নয় ভারতের।

চীন এখন ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক পার্টনার, কিন্তু চীনের কাছে ভারত আদৌ তা নয়। চীনের সাথে বাণিজ্য ভারতের কাছে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, সেই বাণিজ্যের ওপর দিল্লির যে নির্ভরতা, চীনের কাছে ভারতের বাজারের গুরুত্ব আদৌ ততটা নয়।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, ভারতে সরকারের পক্ষ থেকে যে হম্বিতম্বি করা হচ্ছে তা মূলত সীমান্ত পরিস্থিতি নিযে ক্রোধের বহি:প্রকাশ। বাস্তবে ভারত সরকার জানে প্রতিবেশি চীনের বাজার কতটা লোভনীয় এবং বহু চীনা পণ্যের কোনো বিকল্প তাদের সামনে নেই। ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং শিল্প মালিকরা মনে করছেন চীনের সাথে ব্যবসা এখন তাদের কাছে সবচেয়ে ভালো বিকল্প।