আসাম : মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১৫ জুলাই ২০২১, ১১:৫৪

বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন ভারতের আসামে মুসলিম নিপীড়ন বেড়েই চলেছে। সেখানকার ক্ষমতাসীন হিন্দুত্ববাদী বিজেপির রাজ্য সরকার মুসলিমদের বিরুদ্ধে একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি, মাদ্রাসা বন্ধ করা ও মুসলিমদের উচ্ছেদের পর এবার রাজ্যটিতে কার্যত গরুর মাংস নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশের পর এবার হিন্দুত্ববাদের নতুন উপকেন্দ্র হয়ে উঠেছে বিপুল মুসলিম জনসংখ্যার আসাম।

কংগ্রেস থেকে বিজেপি নেতায় পরিণত হওয়া আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ^শর্মা নিজেকে উগ্র হিন্দুত্ববাদী প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। ভোটের রাজনীতির জন্য মুসলমানদের অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং নিপীড়নকে কৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন। এরই সর্বশেষ প্রমাণ মিলেছে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার উদ্যোগের মাধ্যমে।

আসামে ১৪ বছরের বেশি বয়সী গরু জবাইর ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মতে, ১৯৫০ সালের আইন গো-রক্ষার ক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তাই তিনি বিধানসভায় নতুন বিল নিয়ে এসেছেন। নতুন বিলে বলা হয়েছে, হিন্দু ও শিখ বসতি এলাকা এবং কোনো মন্দিরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে গরুর মাংস বিক্রি করা যাবে না।

গত ১২ জুলাই আসাম গো-রক্ষা বিল বিধানসভায় পেশ করেন হিমন্ত। বিলে গরুর মাংস খাওয়া ও বেআইনি গরুপাচার বন্ধ করার কথাও বলা আছে। আর যে সব জায়গায় মূলত হিন্দু, শিখ ও জৈনরা থাকেন সে সব জায়গায় এবং মন্দিরের পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে গরুর মাংস বিক্রি করা যাবে না, কেনাও যাবে না।

ভারতের অনেক রাজ্যেই গরু হত্যা বন্ধ করার আইন রয়েছে। কিন্তু গরুর মাংস কোথায় বিক্রি করা যাবে বা যাবে না তা নিয়ে এই প্রথমবার আইন করা হচ্ছে। বিলে বলা হয়েছে, বৈধ নথিপত্র ছাড়া কোনো রাজ্য থেকে আসামে গরু আনা যাবে না। আসাম থেকেও কোথাও গরু নিয়ে যাওয়া যাবে না। হিমন্ত এর আগে বলেছিলেন, বাংলাদেশে গরু পাচার রুখতে তিনি আইন করবেন। বাংলাদেশের সঙ্গে আসামের ২৬৩ কিলোমিটারের সীমান্ত রয়েছে।

আসাম বিধানসভার বিরোধী দলনেতা কংগ্রেসের দেবব্রত সাইকিয়া বলেছেন, বিল নিয়ে আইনজীবীদের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে। পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়েছে। পাঁচ কিলোমিটার কীসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করা হবে? যেখানে ইচ্ছে সেখানে পাথর ফেলেই তো মন্দির বানিয়ে ফেলা যায়। এই বিলের ফলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়বে। রাজ্যের মুসলিম নেতা আমিনুল ইসলাম বলেছেন, মুসলিমদের মনে আঘাত করার জন্য এই বিল আনা হয়েছে। এর লক্ষ্য বিভাজন তৈরি করা।

বিশ্লেষককরা বলছেন, আসামের দীর্ঘদিন ধরেই মুসলিমবিরোধী রাজনীতি করছে বিজেপিসহ কয়েকটি সংগঠন। তারই ধারাবাহিকতায় এই গরুর মাংস নিষিদ্ধ করার বিল উত্থাপন করা হলো। আসামসহ অবিভক্ত বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকায় একসময় বর্ণ হিন্দু জমিদারদের রাজত্বে গরু জবাই নিষিদ্ধ ছিল। কেউ জবাইয়ের জন্য গরু নিয়ে গেলে জমিদারের কাছারি বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার ওপর বর্বর অত্যাচার করা হতো। আসামের মুসলমানদের জন্য এখন সেই সময় যেনো ফিরে এসেছে।

বছরের পর বছর ধরে আসামে প্রচারনা চালানো হয়েছে, সেখানকার বাংলাভাষী মুসলমানরা বহিরাগত। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারী। একইসাথে প্রচারনা চালানো হতো যে আসাম সেকেন্ড কাশ্মীর। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের ফলে আসামে অসমীয়া ভাষীরা একদিন সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। আসাম হবে মুসলিম প্রধান। এমন প্রচারনা চালানো হয়। এসব প্রচারণার ধারাবাহিকতায় আসামে এনআরসি করা হয়।

আসামের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই মুসলিম। এনআরসি করতে গিয়ে দেখা যায় আসামের বাংলাভাষী মুসলিমরা আসামের স্থানীয় বাসিন্দা। বরং অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধিবাসীর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নেই। কিন্তু এনআরসির ফলে মানুষের ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছিলো। গরিব ও দিনমজুর শ্রেণির মানুষরা কাজ-কর্ম বাদ দিয়ে ডকুমেন্ট জোগাড় করার জন্য ছুটতে হয়েছিল নানা জায়গায়। শারিরীক-মানসিক-আর্থিক সবদিক থেকে বিপুল মুল্য দিতে হয়েছিল তাদের।

এরপর শুরু হয় আসামের আলিয়া মাদরাসা বন্ধ করে দিয়ে সেখানকার মুসলমানদেরকে দুর্বল করে দেয়ার আরেক প্রচেষ্টা। মুসলমানরা আর্থিক সহায়তা দিয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্টান দাঁড় করিয়েছিলো। এখন ক্ষমতার জোরে আসামের বিজেপি সরকার সেগুলা দখল করে নিচ্ছে।

এর সাথে শুরু হয়েছে নানা প্রক্রিয়ার মুসলিম উচ্ছেদ অভিযান। নদীভাঙনের ফলে যেসব বাঙ্গালী হিন্দু এবং বাঙ্গালী মুসলমান বনবিভাগের জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিল তাদের মধ্যে থেকে মুসলমানদেরকে টার্গেট করা হচ্ছে। কোন ধরনের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করেই উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। এখন বলা হচ্ছে, যাদের দুই সন্তানের বেশি রয়েছে তাদেরকে রাজ্যের নানা ক্ষেত্রে কোণঠাসা করা হবে।

আসামে ভূমিধস, নদীভাঙ্গন ও বন্যায় প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। এদের পুর্নবাসনের কোনো উদ্যেগ নেই সরকারের। কিন্তু নদীভাঙ্গন উদ্বাস্তু অসহায় মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই কেড়ে নিতেই বেশি সক্রিয় সরকার। এছাড়া তথাকথিত উন্নয়নের নামে সারা দেশে প্রতি বছর যে লাখ লাখ লোক উচ্ছেদ হন তার প্রায় ১০০ শতাংশই দলিত আদিবাসী ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ।

বিশ্লেষকরা বলনে, এনআরসি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আসামের মুসলমানদেরকে বহিরাগত প্রমান করা যায়নি। তাই তাদেরকে হেনস্থা করার জন্য একের পর এক নতুন নতুন উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। অবশ্য এনআরসি প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে হিমন্ত শর্মার সরকার।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিজেপিতে টিকে থাকতে হিমন্ত শর্মা হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডাকে ব্রহ্মাস্ত্র বানিয়েছেন। ৬ বছর আগে কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেন তিনি। তার আগে রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে বাজে পারফর্ম করলেও সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের পর নাটকীয়ভাবে মুখ্যমন্ত্রীর পদে আসীন হন তিনি।

বিধানসভা নির্বাচনের সময় হিমন্ত বিশ^শর্মা নজিরবিহীন মুসলিমবিরোধী বক্তব্য দেন। তিনি আসামে সভ্যতার লড়াই বা সিভিলাইজেশন ওয়ার চলছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। এ লড়াইয়ে বাঙালি মুসলিমদের হাত থেকে আসামকে বাঁচাতে হবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।

তারা বিরুদ্ধে সংঘ পরিবার অতীতের কংগ্রেস সংশ্লিষ্টতার খোটা দিচ্ছে। সেটা ভোলাতে তিনি আরও বেশি হিন্দুত্ববাদী নীতি গ্রহণ করছেন। তিনি আসামে দীর্ঘদিন ধরে চলা তথাকথিত বাঙালি মুসলিম বিরোধী আসামি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সঙ্গে এবার হিন্দুত্ববাদের উপকরণ যুক্ত করছেন। অনেকেই উত্তরপ্রদেশের আরেক মুসলিমবিরোধী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে তার তুলনা করতে শুরু করেছেন।

হিমন্ত শর্মার মুসলিমবিরোধী অবস্থানের বহু উদাহরণ আছে। সম্প্রতি রাজ্যের হোজাই জেলায় একটি করোনা চিকিৎসক কেন্দ্রে একজন চিকিৎসকের অবহেলায় এক রোগীর মৃত্যু হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে মারধর করে কিছু মুসলিম তরুণ। এ ঘটনায় ২২ মুসলিমের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরদিন এক টুইটে তিনি তাদের সবার নামোল্লেখ করে বলেন, মামলাটি তিনি নিজেই তদারকি করবেন। তার ওই টুইটে হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমবিদ্বেষ উগড়ে দেয়।

ভারতে কভিড রোগীদের ক্ষুব্ধ স্বজনদের হাতে আরও বহু ডাক্তার নিগৃহীত হয়েছে, যার বেশিরভাগই ঘটেছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের হাতে। হিমন্ত বিশ^শর্মা শুধু মুসলিম তরুণদের ঘটনাটিতেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন।

এর আগে ভারতে তাবলিগ জামাতের কিছু কর্মী করোনায় আক্রান্ত হলে তিনি সেটিকেই বড় ইস্যু বানান। কিন্তু এরপর দেখা যায়, ভারতে করোনা ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ে দেশটিকে কার্যত মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে। এর সঙ্গে তাবলিগ জামাতের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এজন্য বহুলাংশে দায়ী ছিল হিন্দুদের কুম্ভমেলা। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত শর্মা এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন।

হিমন্ত বিশ^শর্মা ২০ বছর কংগ্রেস করেছেন। ২০১৪ সালে জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। বিভিন্ন সময় তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আসামের অবস্থান ভারতের অন্যান্য রাজ্যগুলির তুলনায় অনেক পিছিয়ে। এরপরও স্থানীয় গণমাধ্যমে তাকে একজন দক্ষ ব্যবস্থাপক হিসেবে তুলে ধরা হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একজন মাঝারি মাপের নেতা হলেও তাকে যোগ্য ও সাহসী শাসক হিসেবে তুলে ধরে দেশটির বেশিরভাগ গণমাধ্যম। একই ঘটনা ঘটছে হিমন্ত বিশ^শর্মার ক্ষেত্রেও। এক্ষেত্রে হিমন্ত বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন গণমাধ্যমবান্ধব রাজনীতিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। তার পরিবারের মালিকানায় রয়েছে আসামের একটি টিভি চ্যানেল ও একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকা। সেটাকে কাজে লাগাচ্ছেন তিনি। গৌহাটি বিশ^বিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক অখিল রঞ্জন দত্ত মনে করেন, হিমন্ত বিশ^শর্মার দক্ষ প্রশাসকের ভাবমূর্তি একেবারেই বানোয়াট। তার এ ভাবমূর্তি তৈরি করেছে মূলত গণমাধ্যমগুলো।