কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর অন্তহীন গুম


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৩ জুলাই ২০২১, ১৫:০৬

বিশ্বে যেসব অঞ্চলে সবচেয়ে বর্বর শাসন চলছে, ভারত-শাসিত কাশ্মীর তার অন্যতম। সেখানে নিরাপত্তাবাহিনী প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়। তবে কাশ্মীরিদের জন্য খুব সম্ভবত সবচেয়ে বেদনাদায়ক হচ্ছে নিরাপত্তা বাহিনী হাতে অসংখ্য গুমের ঘটনা। গুমের শিকার পরিবারগুলো নানাভাবে লড়ছে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে।

২০১৯ সালের ২৯ নভেম্বরের মধ্যরাতে দরজায় অস্বাভাবিক ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভেঙে যায় হোসেনের পরিবারের। ভয়ে পুরো পরিাবরটি কুঁকড়ে যায়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আসার খবর শুনে দরজা খুলে দেন হোসেন। সেনারা বাসায় ঢুকেই খোঁজাখুঁজি করতে থাকে তার ছেলে নাসির আহমেদের। এ-সময় তারা বাসার সবকিছু তছনছ করে ফেলে। এক পর্যায়ে নাসিরকে নিয়ে চলে যায় সেনারা। হোসেন তার ছেলের সঙ্গে যেতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়া হয়। সেনারা তাদের গাড়িতে নাসিরকে তুলে নিয়ে নেওয়ার সময় তিনি ‘বাবা বাবা’ বলে চিৎকার করছিলেন আর বলছিলেন, আমাকে বাঁচান।

পরদিন হোসেন এবং তার পরিবার স্থানীয় কিগাম থানায় এফআইআর দায়ের করতে গেলে পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয় এবং সেনাক্যাম্পে যোগাযোগ করতে বলে। হোসেন ছুটে যান শাজিমার্গ আর্মি ক্যাম্পে। সেনারা তাকে জানান, নাসিরকে পরদিন ছেড়ে দেওয়া হবে। পরদিন নাসিরকে আনতে গেলে আর্মি জানায় যে, তাকে আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নাসির আর বাসায় ফেরেনি।

পুলিশ দাবি করে, নাসির জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছে। কিন্তু সেটা সত্যি হলে সে তো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। পরিবারের আশঙ্কা, নাসিরকে গুম বা হত্যা করেছে সেনাবাহিনী।

নাসিরের মতো হাজার হাজার তরুণকে গুম করেছে ভারতের সেনাবাহিনী। নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে কাশ্মীরে স্বাধীনতা আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে অন্তত ৮ থেকে ১০ হাজার তরুণকে গুম করেছে ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী। অ্যাসোসিয়েন অফ প্যারেন্টস অফ ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পিপল বা এপিডিপি তাদের সবার তথ্য সংগ্রহ করেছে। এসব হতভাগা মানুষগুলো বেঁচে নাকি তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে তা জানে না তাদের পরিবার। পরিবারের সদস্যররা তাই বছরের পর বছর তাদের ফেরার অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু তারা আর ফিরে আসে না।

মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে ভূস্বর্গ খ্যাত এই উপত্যকার অন্তত ৭০ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে যাদের বেশিরভাগই মারা গেছে ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। কাশ্মীরে গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের স্ত্রী আর মায়েদের প্রাত্যহিক জীবনের লড়াই নিয়ে গবেষণা করেছেন নৃবিজ্ঞানী আতহার জিয়া। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া- আরভাইনে তার পিএইচডি থিসিসে উঠে এসেছে এসব মানুষের বেদনার চিত্র।

মুসলিম আইনে কোন নারী বিধবা হয়ে গেলে আবার বিয়ে করতে পারে। কিন্তু কাশ্মীরে কারও স্বামী গুম হয়ে গেলে ৭ বছরের মধ্যে আবার বিয়ে করতে পারে না। তবে কাশ্মীরের গুমের ঘটনা এত ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যায় যে, সেখানে আলেমরা শেষমেশ ফতোয়া জারি করেন যে, কারও স্বামী গুম হলে ৪ বছর পর সে বিয়ে করতে পারবে। কিন্তু আতহার জিয়া দেখান, বাস্তবে প্রায় ৯১ শতাংশ মেয়েই আর বিয়েতে আগ্রহী-ই হয়ে উঠে না। এসব মেয়েরা জানেই-না তার স্বামী আদৌ বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন। আতহার জিয়া এটার নাম দিয়েছেন “হাফ-উইডো”। এরকম-ই এক ‘হাফ-উইডো’ সাদাফের প্রাত্যহিক দিনলিপি জিয়া খুব সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করেন।

কাশ্মীরি এবং মোটাদাগে মুসলমান সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে মেয়েরা হারিয়ে যাওয়া মানুষদের জন্য ঘরে বসে আড়ালে শোক-বিলাপ করে, কান্না করে। কিন্তু সাদাফদের মতো অনেক হাফ-উইডো ঠিক ঘরে বসেই শোক পালন করে না। প্রতিমাসে তারা নিখোঁজ স্বামী-সন্তান-বাবার ছবি নিয়ে সমাবেশ করে, তাদের স্মরণ করে।

গুম হয়ে যাওয়া এসব মানুষদের পরিবারের সদস্যদের সংগঠন এপিডিপির মাধ্যমে সাদাফের মতো মেয়েরা প্রতিনিয়ত তাদের লড়াই জারি রেখেছে ভারতীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে।

এখানে নারীরা লড়াই করছে, গুম হয়ে যাওয়াদের খুঁজছে। স্মরণসভা থেকে ফিরেও তাদের দৈনন্দিন লড়াইগুলো থেমে থাকেনা। সাদাফ মারাত্মক নস্টালজিয়াতে ভোগে। ঘরে যখন সে এক কাপ চা বানায়, মাঝে মাঝে আরেকটা কাপ বানায়ে রাখে স্বামী মনজুর খাবে বলে। স্বামীর জামা-কাপড় খুব সুন্দর করে পরিপাটি করে রাখে, তার বিশ্বাস সে একদিন ফিরে আসবে। ঘরে আসা মাত্রই সাদাফ প্রায়-ই উজ্জ্বল বা লাল কালারের জামা পরে।

যখন মনজুর ছিল, সাদাফ তখন ঘরে-বাইরে সবসময় নিজেকে সুন্দর রাখার চেষ্টা করত, প্রায়ই সেজেগুজে থাকত, যেটা তার স্বামীর খুব পছন্দও ছিল। কিন্তু সে এখন যখন ঘরের বাইরে যায়, আর উজ্জ্বল জামাটা পড়ে না। একটা চাদর গায়ে দিয়ে যায়। তার স্বামী গুম হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে তার জীবনের শখ আহ্লাদগুলো সব হারিয়ে গেছে। সারাক্ষণ স্বামীর দুশ্চিন্তায় থাকতে থাকতে সাদাফের চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে, রাতে ঘুম হয় না। শরীরে এসেছে অস্বাভাবিক পরিবর্তন। তাই বলে তার লড়াইটা থেমে থাকেনি কোনদিন।
প্রতি মাসে এপিডিপির কর্মসূচিতে যাচ্ছেন, যখন-ই শুনছে কোথাও একটা লাশ পাওয়া গেছে বা একটা বন্দীকে দেখা গেছে, সেখানেই দৌড়ে যাচ্ছেন। ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে, জেল থেকে জেলে, থানা থেকে থানায় ছুটছেন সাদাফ।

ভারত রাষ্ট্রে কেউ গুম হলে সহজেই পুলিশ কোন জিডি বা এফআইআর নিতে চায় না, ফলে কতজন গুম হয়েছে রাষ্ট্রের তরফ থেকে তার সঠিক কোন সঠিক তথ্য নেই। এভাবে থানা বা আদালতে অভিযোগ গ্রহণ না করার মাধ্যমে রাষ্ট্র গুম হয়ে যাওয়া মানুষদের সংখ্যাকেও গুম করে দেয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। সাদাফ এরপরও থানায় যায়।

একসময় পাড়ার সবাই সাদাফকে বলিউড স্টার বলত, এখন তার চেহারার দিকে তাকিয়ে সবাই বলে, সে বয়সের ছেড়ে বুড়ো হয়ে গেছে। সাদাফ একসময় এনেস্থেশিয়ান ছিল, স্বামী গুম হয়ে যাওয়ার পর চাকুরি ছেড়ে এখন একটা বিউটি পার্লার করেছে যাতে বাইরে কোনো পুরুষ মানুষের সাথে সাক্ষাৎ করা না লাগে। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে পুরো সংসার সামলাচ্ছে।

কাশ্মীরের আরেক হতভাগ্য পিতা মঞ্জুর আহমেদ ওয়াগাইর বিষয়টি আবার অন্যরকম। গত বছরের আগস্টে তার ছেলে শাকির মঞ্জুরকে অপহরণ করে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। শাকির ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করতো। আশঙ্কা করা হচ্ছে তিনি হয়তো কাশ্মীরের স্বাধীনতাকমীদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। তাই ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীই তাকে গুম করেছে।

শাকিরের পরিবারের বিশ্বাস, সে আর জীবিত নেই। এ অপহরণের পর নয় মাস পেরিয়ে গেছে। তার পিতা মঞ্জুর এখনো ছেলের মৃতদেহ খুঁজে ফিরছেন।

শাকিরের বাবা তার ছেলেন খোঁজ শুরু করেছিলেন সেই গ্রাম থেকে - যেখানে তার ছেঁড়া কাপড় চোপড় পাওয়া গিয়েছিল। এর আশপাশে আরো ৫০ কিলোমিটার জাযগাতেও তারা তল্লাশি চালিয়েছে মরদেহের। যেখানে আছে ফলের বাগান, ছোট ছোট পাহাড়ী নদী, ঘন জঙ্গল আর গ্রাম - সবখানে তিনি তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন তারা।

মঞ্জুরের আরেক ছেলে শাহনেওয়াজ তার বাবাকে সাহায্য করার জন্য গত বছর কলেজে যাওয়া ছেড়ে দেন। তারা কিছু নদী খোঁড়ার জন্য কয়েক বার খনন করার যন্ত্রও ভাড়া করেছিলেন। কখনো কখনো তাদের বন্ধু আর প্রতিবেশীরাওকোদাল-শাবল নিয়ে তাদের সাথে অনুসন্ধানে যোগ দিয়েছে।

স্থানীয় পুলিশের প্রধান দিলবাগ সিং সম্প্রতি বলেছেন, শাকিরের অনুসন্ধান শেষ হয়নি। তবে তিনি তদন্তের বিস্তারিত তথ্য দিতে অস্বীকার করেন। মঞ্জুর বলেন, আমি যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন ছেলের মরদেহের সন্ধান চালিয়েই যাবো।

ভারতীয় খ্যাতিমান লেখক অরুন্ধতী রায় নিউইয়র্ক টাইমসে এক নিবন্ধে লিখেছেন, কাশ্মীর বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ সামরিক এলাকা। সেখানে সামান্য কিছু বিদ্রোহীকে দমন করার জন্য ভারত ৫ লাখ সেনাকে মোতায়েন করে রেখেছে। সেখানে কুখ্যাত আবু গ্রাইব বন্দিশিবিরের মতো ভারতীয় বাহিনীও চর্টার চেম্বার ব্যবহার করে থাকে।

অরুন্ধতী আক্ষেপ করে লিখেছেন, কিন্তু ভারতীয় কথিত উদারপন্থীরাও সরকারের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে কথা বলেন না। নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার হলেও কাশ্মীরিদের অধিকারের ব্যাপারে তারা দ্বিমুখী নীতি অবলম্বন করে থাকেন।