মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কেন মরিয়া বিজেপি


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ৩০ জুলাই ২০২১, ১৫:৪৫

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি সরকার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঠেকানোর কথা বলে এই উদ্যোগ নেওয়া হলেও বিশেষজ্ঞরা তাতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা বলছেন, ভারতে এখন জনসংখ্যা তেমন বাড়ছে না। অনেকের আশঙ্কা, মুসলিমদের সন্তান ধারনের ওপর কড়াকড়ি আরোপের জন্য এই পদক্ষেপ হিয়েছে হিন্দুত্ববাদী দলটি।

ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি হঠাৎ করেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হয়েছে। উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের মাস ছয়েক আগে উগ্র হিন্দুত্ববাদী মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বিল এনেছেন। সেখানে দুইটির বেশি সন্তান হলে সরকারি সুযোগসুবিধা ও চাকরি বন্ধ হয়ে যাবে। আসামে আরেক ধাপ এগিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা নিয়োগ করার কথা ঘোষণা করেছেন।

ভারতের সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা উত্তরপ্রদেশে, প্রায় ২২ কোটি। এই রাজ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঠেকাতে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির দুটির বেশি সন্তান থাকলে তিনি স্থানীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। তিনি চাকরিতে পদোন্নতি পাবেন না। এ ছাড়া পাবেন না সরকারের ভর্তুকি। এমনকি সরকারি চাকরির অযোগ্য হিসেবেও বিবেচিত হবেন ওই ব্যক্তি।

উত্তরপ্রদেশ সরকারের এই নতুন উদ্যোগের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এরকম জবরদস্তিমূলক নীতি গ্রহণ করা হলে অনিরাপদ গর্ভপাত বেড়ে যেতে পারে। বিশেষ করে সন্তান ছেলে হবে না মেয়ে হবে, সেটা নির্ধারিত হওয়ার পর গর্ভপাত বেড়ে যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে পপুলেশন ফাউন্ডেশন অব ইন্ডিয়ার নির্বাহী পরিচালক পুনম মুত্রেজা বলেন, প্রজননস্বাস্থ্য, শিশু, মাতৃমৃত্যু এবং বার্ধক্যের ক্ষেত্রে ভারতে যেসব নীতি রয়েছে ; নতুন আইন তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক । তাছাড়া এ প্রদেশে জনসংখ্যা এখন তেমন বাড়ছেও না। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে এখনকার মোট উর্বরতার হার বা টিএফআর অর্ধেকে নেমে এসেছে। ১৯৯৩ সালে উর্বরতার হার ছিল ৪ দশমিক ৮। ২০১৬ সালে তা ২ দশমিক ৭ এ নেমে এসেছে। ২০২৫ সালে এটা হবে ২ দশমিক ১। এটাই কাংখিত উর্বরতার হার। টিএফআর হলো একজন নারী গড়ে কতগুলি সন্তান জন্ম দেন।

এদিকে আসামের মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক হাজার যুবককে নিয়োগ করা হবে। তাদেরকে সেনা হিসেবে উল্লেখ করেছেন তিনি। এই সেনা নিয়োগ করা হবে প্রধানত লোয়ার আসামে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি। তবে তিনি আপার আসামের মানুষদের জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সেনা নিয়োগ করছেন না।

হিমন্ত বিশ্বশর্মা দাবি করেছিলেন যে, মুসলিমদের জন্যই আসামে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেয়ার পর তিনি বলেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উচিত আত্মসমীক্ষা করা। কারণ, তাদের জন্য জন্মনিয়ন্ত্রণে সমস্যা হচ্ছে।

তিনি দাবি করেছেন , ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আসামে হিন্দু জনসংখ্যা ১০ শতাংশ বাড়লেও মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে ২৯ শতাংশ। পরিবার ছোট বলে হিন্দুদের জীবনযাত্রার মান উন্নত। তাদের ভালো বাড়ি, গাড়ি আছে। ছেলেমেয়েরা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হন। তবে মুখ্যমন্ত্রী কোথা থেকে এই সংখ্যাতত্ত্ব পেয়েছেন তা জানাননি।

এদিকে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যেও জনসংখ্যা নীতি তৈরির দাবি তুলেছেন বিজেপি বিধায়ক অগ্নিমিত্রা পাল। বিধানসভাতেও এ নিয়ে তিনি সরব হতে চান । যোগী আদিত্যনাথের দেখানো পথে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাঁটা উচিত বলে মন্তব্য করেন অগ্নিমিত্রা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ এখন আর জরুরি নয়। দেশটির বেশ কয়েকটি রাজ্যে জনসংখ্যা নিম্নমুখী। আবার উত্তরপ্রদেশের মত কয়েকটি রাজ্যে জনসংখ্যা কিছুটা বেশি হলেও অচিরেই তা প্রতিস্থাপন হার বা রিপ্লেসমেন্ট রেটের সমান হয়ে যাবে। কোনো দেশে উর্বরতার হার ২ দশমিক এক শতাংশ হলে সেটাকে রিপ্লেসমেন্ট রেট বলে। তার মানে এই দেশের জনসংখ্যা আর বাড়বে না। উত্তরপ্রদেশ ২০২৫ সালের মধ্যেই এই হারে পৌছে যাবে।

ভারতের জনসংখ্যা ফাউন্ডেশনের পুনম মুত্রেজা বলেন, উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের কোনও প্রমাণ নেই। তিনি জানান, ভারতের জনসংখ্যা নীতিগুলি জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার পরিবর্তে মানুষের অধিকার এবং মর্যাদার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত।

আউটলুক ম্যাগাজিনের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ভারতে জনসংখ্যা বিস্ফোরণের আশঙ্কা জাতীয় বা বৈশ্বিক তথ্য দ্বারা প্রমাণিত নয়।

চীন সম্প্রতি তার দুই সন্তান নীতি সংশোধন করে এবং দম্পতিদের তিনটি পর্যন্ত সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেয়। পুনম মুত্রেজা বলেন, ভারতের অবশ্যই চীনের ব্যর্থ অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে হবে। কঠোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চীনের জন্য জনসংখ্যা সঙ্কট তৈরি করেছে। এসব সত্ত্বেও ভারতে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন জবরদস্তি করা হচ্ছে?

এর কারণ বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষ। বিজেপি নেতাদের আশঙ্কা মুসলিম জনসংখ্যা যেহারে বাড়ছে তাতে এক সময় ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের বেশি হয়ে যাবে। তাদের কারো কারো দাবি, মুসলিমরা হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। যদিও তাদের এ দাবি ভ্রান্ত এবং বিশেষজ্ঞরা তা উড়িয়ে দিয়েছেন। তবে অনেক বিজেপি নেতা তা মানতে নারাজ।

যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক পিউ রিসার্চ সেন্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে মুসলমানদের সংখ্যা প্রায় ১৮ দশমিক ৪ শতাংশ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর অর্থ আগামী ৩০ বছর পরেও ভারতের মুসলমান জনসংখ্যা ৩০ শতাংশের কাছাকাছি হবে না।

এক মামলায় মোদি সরকার ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্টকে বলেছিল যে সরকার পরিবার পরিকল্পনায় জবরদস্তির বিরুদ্ধে ছিল। ভারতীয় দম্পতিরা এখন গড়ে দুই সন্তানের বেশি চায় না।

জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য জরিপ অনুসারে, মোট উর্বরতার হার বা টিএফআর দরিদ্রদের মধ্যে বেশি এবং আয় বাড়ার সাথে সাথে এটি হ্রাস পায়। মোদি সরকারের হলফনামায় আরও বলা হয়েছে, ভারতে টিএফআর হ্রাস পাচ্ছে।

তা সত্ত্বেও হিন্দত্ববাদী নেতাদের চাপে বিতর্কিত ও ধর্মীয় বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনের পর মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ফন্দিফিকির করছে বিজেপির রাজ্য সরকারগুলো। ক্ষমতাসীন জোটের শরিক দল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত চাচ্ছেন, যেকোন মূল্যে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে। আরএসএস কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ভারতে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার জন্য মুসলিমদের দায়ী করে সরকারকে তা নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে।

ভারতের আদমশুমারির হিসাব বলছে, দেশটিতে মুসলিমদের মধ্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতি ১০ বছরে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ধাপে ধাপে কমে আসছে। ভারতের ২০১১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, ১২১ কোটি মানুষের মধ্যে হিন্দু ছিল ৯৬ দশমিক ৬৩ কোটি বা মেটা জনসংখ্যার প্রায় ৮০ ভাগ। অন্যদিকে মুসলিম ছিল ১৭ দশমিক ২২ কোটি বা মোট জনংখ্যার ১৪ শতাংশ। বর্তমানে ভারতের ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে মুসলিম প্রায় ২০ কোটি বা মোট জনসংখ্যার ১৫ ভাগ।

নব্বইয়ের দশক থেকে ভারতের ১২টি রাজ্য দুই সন্তান নীতি বাস্তবায়ন করেছে। এজন্য কোনো কোনো রাজ্য দিয়েছে আর্থিক প্রণোদনা আর অন্যরা নিয়েছে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। দেখা গেছে এতে হিতে বিপরীতও হয়েছে। ছেলে সন্তানের জন্য গর্ভপাত বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষরা স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়েছে। আবার নির্বাচনে লড়ার জন্য সন্তানকে দত্তক দিয়েছে।

বিহারে ২০০৭ সালে দুই সন্তান নীতি বাস্তবায়ন শুরু হলেও সেখানে উর্বরতার হার দেশটির মধ্যে সর্বোচ্চ তথা ৩ দশমিক ৪। আবার কর্ণাটক ও তামিল নাড়ুতে এ নীতি গ্রহণ না করলেও সেখানে উর্বরতার হার লক্ষ্যণীয়ভাবে কম।

বিজেপির এই উদ্যোগের সমালোচনা হয়েছে রাজনীতিকদের তরফ থেকেও। কংগ্রেস নেতা সালমান খুরশিদ বলেছেন, রাজনীতিবিদদের উচিত তাদের নিজেদের কতটি সন্তান রয়েছে তা ঘোষণা করা।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন কোনও আইন দিয়ে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কেবল তখনই ঘটতে পারে যখন নারীরা সচেতন এবং শিক্ষিত হন।

আসলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সার্বিকভাবে এখন আর বিশ্বের জন্য বড় সমস্যা নয়। অনেক দেশ তো নারীদের বেশি সন্তানধারণের জন্য নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে। বিশ্বের অর্ধেক দেশেই এখন সন্তানধারণের হার নাটকীয়ভাবে কমছে। জাতিসংঘ বলছে, ২০৭০ সাল নাগাদ বিশ্বে উর্বরতার হার প্রতিস্থাপন হারের নীচে নেমে আসবে। জাতিসংঘের পূর্বাভাস হলো, ২০৫৯ সালে ভারতের জনসংখ্যা হবে ১৬৫ কোটি। তবে ২১০০ সালের মধ্যে না নেমে দাড়াবে ১৪৫ কোটিতে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দারিদ্র, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও আর্থিক নিরাপত্তাহীনতা জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে বড় ভ’মিকা রাখে। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি যদি হয়েই থাকে এসব কারণই দায়ী। কিন্তু এসব সমস্যার সমাধান না করে জবরদস্তিমূলকভাবে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা অমানবিক। তারা বলেছেন, ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে। সরকার নারীশিক্ষায় প্রণোদনা, নারীদের কর্মসংস্থানে অগ্রাধিকার দিয়ে এ সাফল্য পেয়েছে। ভারতের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা।