কাশ্মীর নিয়ে বাজিতে হেরে গেলেন মোদি


  • মোতালেব জামালী
  • ১১ আগস্ট ২০২১, ১৫:০৫

নরেন্দ্র মোদির সরকার ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ভারতের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে। সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু ও কাশ্মীর লাদাখ এবং জম্মু-কাশ্মীর নামে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। কাশ্মীরে চলমান ‘বিশৃঙ্খলা’ দমন ও ওই অঞ্চলের উন্নয়ন করার কথা বলে এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই রাজ্যের ডেমোগ্রাফি বা জনসংখ্যাগত হিসাব পাল্টে দেওয়ার টার্গেট নিয়েই ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছিল। উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের উদ্দেশ্য ছিল ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে অমুসলিম লোকজন এনে কাশ্মীরে বসতি স্থাপন করানো। যাতে এখানের মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। একই সঙ্গে যুগ যুগ ধরে লালন করে আসা মুসলিম সংস্কৃতিও যাতে মুছে যায়, সেটাও ছিল অন্যতম লক্ষ্য।

ভারতের এই পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ হয় ৫৭টি মুসলিম দেশের সংগঠন ওআইসি। কাশ্মীরের সাংবিধানিক বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার নিন্দা জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করে সংগঠনটি। পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজারে গত বছর ৫৭টি ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুদিনের এক বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। এই প্রস্তাবে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করার নিন্দা করা হয়েছে কঠোর ভাষায়। প্রস্তাবে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের জন্য ভারতের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সাথে কাশ্মীরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।

ভারত যেভাবে কাশ্মীরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে, আন্তর্জাতিক প্রস্তাব অগ্রাহ্য করছে তা বিবেচনায় নিয়ে ভারতের সাথে সম্পর্ক ‘পুনর্বিবেচনা’ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে ওআইসির প্রস্তাবে। ওআইসির এই প্রস্তাব ভারতের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক ধাক্কা।

কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করার পর বিক্ষোভের ভয়ে দীর্ঘদিন সেখানে কঠোর লকডাউন জারি করে রাখা হয়। রাজনৈতিক কার্যকলাপ, টেলিফোন, মোবাইল, ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন- সবকিছুই। ৩৭০ ধারা বাতিল করার আগেই নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য অতিরিক্ত ৫০ হাজার সৈন্য কাশ্মীরে মোতায়েন করা হয়। গ্রেফতার করা হয় স্বাধীনতাকামী সব নেতা ছাড়াও শত শত মানুষকে।

৩৭০ ধারা বাতিল করার সময় কাশ্মীরে যেসব উন্নয়ন করার কথা ঘোষণা করেছিল মোদির সরকার, তা গত দুই বছরে কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, তা নিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ। গত দুই বছরে কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে কাশ্মীরের? কাশ্মীরিরা বলছেন, দৃশ্যত তেমন কোনো কিছুই তাদের চোখে পড়ছে না। বরং সহিংসতা আরও বেড়ে গেছে।

৩৫ বছর বয়সী ইজাজ গত দুই বছর ধরে মুম্বাইতে থাকেন। কিন্তু তার জন্মস্থান শ্রীনগরে। তিনি বলেন, কাশ্মীরের মানুষ সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করাকে মানছে না। তারা এটাকে সঠিক পদক্ষেপ বলে মনে করছে না। কাশ্মীরিরা ভারতকে আর বিশ্বাস করে না। ভারতের সঙ্গে থাকার ব্যাপারে আমাদের আস্থা কমে গেছে। তিনি আরো বলেন, ৩৭০ ধারা বাতিলের সরকারি বিবৃতিতে কাশ্মীরের অর্থনৈতিক উন্নতির যে কথা বলা হয়েছে সেটা একটা উপহাস মাত্র।

কাশ্মীরের মেয়ে শেহলা রাশিদ দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি-র ছাত্রী। তিনি একজন মানবাধিকার কর্মীও। শেহলার মতে, ৩৭০ ধারা বাতিল করা কাশ্মীরিদের মধ্যে আত্মপরিচয়ের সংকট তৈরি করবে। কারণ জম্মু এবং কাশ্মীর একটা রাজ্য ছিল। তিনটি অঞ্চল জম্মু, কাশ্মীর এবং লাদাখের মানুষ ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম পালন করে। আমরা বড় হয়েছি এই সংস্কৃতিতে। কিন্তু মোদির সরকার রাজ্যকে বিভক্ত করল। এটা শুধু মাত্র দ্বিজাতি তত্ত্বকেই উসকে দেবে না, এটা মানুষের জন্য বড় একটা সাংস্কৃতিক আঘাতও। এই পদক্ষেপ কাশ্মীর ইস্যুকে আরও জটিল করবে।

শ্রীনগরে বিবিসি-র সংবাদদাতা রিয়াজ মাসরুর বলেন, সরকারের ওপর যদি সাধারণ মানুষের আস্থাই থাকত, তাহলে তো বিক্ষোভের ভয়ে কারফিউ জারি করতে হত না। তাদের এই সিদ্ধান্তেই বোঝা যাচ্ছে যে, ৩৭০ ধারা বাতিল করে সাধারণ মানুষের আস্থা নষ্ট করে দিয়েছে সরকার। মানুষ খুশি থাকলে তো রাস্তাঘাট সুনসান থাকত না। বিজেপির সদর দপ্তরেও ধুমধাম হতো। কিন্তু মানুষ যে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি এটা প্রশাসনও বুঝেছে।

কাশ্মীরিদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ছিল যে পর্যটন, তাও বন্ধ হয়ে গেছে লকডাউনের কারণে। কাশ্মীরের মানুষ লকডাউন প্রত্যক্ষ করেছেন ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট থেকে। দেশজুড়ে কোভিড মোকাবিলার জন্য জারি করা লকডাউনের অনেক আগে থেকেই। ফলে এই আঞ্চলের মানুষের জীবন অনেক আগে থেকেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। কাশ্মীরের সাদধারণ মানুষের কথা হচ্ছে, উন্নয়নের কথা বলে মোদি সরকার এই রাজ্যের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করেছে। কিন্তু গত দুই বছরে তো ভালোর দিকে কোনো পরিবর্তন তাদের চোখেই পড়ছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য ভীষণভাবে মার খেয়েছে, সব থেকে ক্ষতি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের।

নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন কাশ্মীরি বলেন, নতুন যে কাশ্মীরের কথা সরকার বলেছিল, তার তো দেখাই পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো কাশ্মীরকে বহু বছর পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাশ্মীর টাইমস পত্রিকার সম্পাদক অনুরাধা ভাসিনে বলেন, যেভাবে সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের চেতনারই বিরোধী।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরে ১৯৮৯ সাল থেকে স্বাধীনতাকামীরা দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। মোদি সরকার কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করার পর যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, এখানে সহিংসতা প্রতিহত করতে এটার প্রয়োজন ছিল।

কিন্তু দু’বছর পরেও নিরাপত্তা বাহিনীতে কর্মরত স্থানীয়দের এবং বেসামরিক মানুষদের ওপর সন্দেহভাজন গেরিলারা টার্গেট করে হামলা চালাচ্ছে। দিল্লিতে কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অজয় সাহনি বলেন, সন্দেহভাজন গেরিলারা এদের বলছে পুলিশের চর বা সহাযোগী। স্থানীয় এসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সদস্যরা তাই তাদের টার্গেট।

কাশ্মীরের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো বলছে, কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গেরিলা পাঠানোর যে অভিযোগ ছিল, সীমান্ত সংঘাত বন্ধে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে সেটা কমে গেছে, কিন্তু কাশ্মীরে সহিংসতা থামেনি।

গত কয়েক মাসে সশস্ত্র বাহিনী এবং স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা খুবই বেড়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরে এ ধরনের লড়াইয়ে এ বছরের জানুয়ারি মাস থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৯০ জন সন্দেহভাজন গেরিলা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে ৮২ জনই স্থানীয়। নিহত গেরিলাদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সীরাও আছে। খবরে জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ স্বাধীনতাকামী সংগঠনে যোগ দিয়েছিল মৃত্যুর মাত্র তিনদিন আগে।

ভারতের সংবাদ সংস্থা পিটিআই-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরে ২০৩ জন গেরিলা নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে ১৬৬ জনই স্থানীয়। ২০১৯ সালে নিহত হয় ১৫২ জন, যাদের মধ্যে ১২০ জনই ছিল স্থানীয় কাশ্মীরি।

ঊর্ধ্বতন একজন নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, কাশ্মীরে সক্রিয় গেরিলাদের তালিকায় এ-বছর বিদেশি কোনো লোকের যোগদানের নজির নেই। বরং এখন প্রতিদিন স্থানীয়রাই স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীতে যোগ দিচ্ছে। তিনি বলেন, এ-বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৭৬ জন কাশ্মীরি হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে এবং এই সংখ্যা বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

শ্রীনগরে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা লেফটেনান্ট জেনারেল দেভেন্দ্রা প্রতাপ পান্ডে বলেছেন, কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসিতে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে যুদ্ধবিরতি লংঘনের একটাও ঘটনা ঘটেনি। কাশ্মীর সীমান্ত দিয়ে কোনো অনুপ্রবেশও ঘটেনি। তবে সীমান্ত থেকে অনেকটা দূরে কাশ্মীরের গ্রাম ও শহরগুলোতে পরিস্থিতি মোটেও শান্ত নেই। সেখানে গেরিলাদের হামলা বেড়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যে উদ্দেশ্য নিয়ে কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করেছিল মোদির সরকার, গত দুই বছরে তার কিছুই অর্জন করতে পারেনি তারা। বরং এই সময়ে কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের তৎপরতা আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। ভারত সরকারের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ স্থানীয় যুবক, তরুণ ও কিশোররা স্বাধীনতাকামী সংগঠনে যোগ দিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের ওপর হামলা করছে।

নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার পর মোদি সরকারের বোধোদয় হয়েছে। গত জুন মাসে নরেন্দ্র মোদি কাশ্মীরের বিভিন্ন দলের নেতাদেরকে দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানান বৈঠকের জন্য। সেই বৈঠকে মোদি বলেছেন, কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাশ্মীর নিয়ে মোদির এই পিছু হটাকে তার জন্য একটি বড় রাজনৈতিক শিক্ষা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।