বিষয়বস্তুর কিছু কিছু দিক নিয়ে সমালোচনা থাকলেও গোয়েন্দা কাহিনী নিয়ে নির্মিত ভারতীয় টিভি সিরিজ ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’ পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। ধর্ম ও জাতীয়তা নির্বিশেষে সব মহলেই ‘দ্য ফ্যামিলি ম্যান’-এর দ্বিতীয় সিজনটি গত দুই মাস ধরে মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখছে।
সিরিজটির প্রথম সিজনে দেখানো হয়েছে, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে স্বাধীনতাকামীদের তৎপরতায় পাকিস্তানের সমর্থন। দ্বিতীয় সিজন নির্মিত হয়েছে শ্রীলঙ্কার তামিল গেরিলাদের ওপর। এতে দেখানো হয়েছে যে, তামিল গেরিলারা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় ভারতে হামলার পরিকল্পনা করছে। সিরিজের দুটি সিজনেই যে অভিন্ন শত্রুকে তুলে ধরা হয়েছে, তার নাম পাকিস্তান।
টিভি সিরিজটিতে কাশ্মীরের স্বাধীনতাকামীদের প্রতি পাকিস্তানের সমর্থন কিংবা বালুচিস্তানের গেরিলাদের সাথে ভারতের কানেকশন আছে বলে পাকিস্তানের অভিযোগের মতো নানা ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। মিডিয়ায় প্রকাশিত বিভিন্ন সংবাদের বরাত দিয়ে এসব বিষয়কে টেনে আনা হয়েছে। এতে দেখানো হয়েছে, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)-এর সহায়তায় শ্রীলঙ্কার তামিল গেরিলাদের সংগঠন লিবারেশন টাইগার্স অব তামিল ইলম (এলটিটিই) ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে হামলার পরিকল্পনা করছে।
চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, ভারতীয় টিভি সিরিজের কাহিনীতে আইএসআই ও এলটিটিই-র মধ্যে সম্পর্ক দেখানো হলেও বাস্তবে পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক আগে থেকেই রয়েছে। দিনদিন এই সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। শ্রীলঙ্কা তার বৃহত্তম প্রতিবেশী দেশ ভারতের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে। এর কারণ হচ্ছে পাকিস্তান ভূরাজনৈতিক সম্পর্কের পরিবর্তে ভূঅর্থনৈতিক সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে শ্রীলঙ্কাকে কাছে টানতে চাইছে।
ঐতিহাসিভাবেই পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যে সংঘাতমুক্ত ও একটি স্থিতিশীল সম্পর্ক বিরাজ করছে। ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানের বিমানগুলোকে মাঝপথে জ্বালানি ভরার সুযোগ দিয়েছিল। অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে দুই দেশের সম্পর্ক আগে থেকেই অনেক গভীর ও তুলনামূলকভাবে খুবই স্থিতিশীল। একবিংশ শতাব্দীতে এসে এই সম্পর্ক আরও জোরোলো হচ্ছে। বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও প্রতিরক্ষা খাতে অংশীদারিত্ব দুই দেশের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে। কৌশলগত এই অংশীদারিত্বকে কিভাবে আরও সামনে এগিয়ে নেওয়া যায়, তা নিয়ে কাজ করছে দুই দেশই। কৌশলগত এই অংশীদারিত্বের মাধ্যমে দুই দেশ দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের সমন্বিত রাজনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে বলে বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন।
গত ২০ জুলাই শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত পাকিস্তানের হাইকমিশনার মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ সাদ খটক কলম্বোতে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি দুই দেশের মধ্যে জোরালো অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তার বক্তব্য তুলে ধরেন। এ-সময় তিনি ঘোষণা দেন, রাওয়ালপিন্ডি চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল শ্রীলঙ্কা সফরে আসবে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এই বার্তা দিয়েছে যে, গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের শ্রীলঙ্কা সফর দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট সম্পর্কের ভিত্তিকে অনেক বেশি মজবুত করেছে।
ইমরান খানের সফরের আগে ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে কলম্বোতে পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা যৌথ অর্থনেতিক কমিশনের (জেইসি) ১২তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ-সময়ই দীর্ঘ ৭ বছর পর দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অটো সেক্টর নিয়ে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপকে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ইমরান খানের সফরের সময়ই পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্মেলন ২০২১ ও বিজনেস টু বিজনেস (বিটুবি) নেটওয়ার্কিং সেশন অনুষ্ঠিত হয়। দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করার লক্ষ্যেই এসব বৈঠক হয়।
পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কা মুক্তবাণিজ্য চুক্তি কার্যকর হয় ২০০৫ সালে। এরপর ২০১১ সালে পাকিস্তান শ্রীলঙ্কাকে চিনি ও সিমেন্ট কারখানা নির্মাণ খাতে সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাব দেয়। এরপর ২০১২ সালে স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের মাধ্যমে ২০ কোটি ডলারের রপ্তানি ঋণ সুবিধা প্রদানের প্রস্তাবও শ্রীলঙ্কাকে দেয় ইসলামাবাদ। দ্বীপ রাষ্ট্রটির সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভূঅর্থনৈতিক সম্পর্কে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হলেও অনেক সময়ই প্রয়োজনের তাগিদে ভূরাজনৈতিক সম্পর্ককেও অগ্রাধিকার দিয়েছে পাকিস্তান।
কিন্তু তারপরও শ্রীলঙ্কায় ভারতের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বেশি। এ দুটি বিষয় ভারতের চিরশত্রু প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে শ্রীলঙ্কার সম্পর্ক নির্ধারণের ক্ষেত্রে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়ে আসছে। যদিও শ্রীলঙ্কা পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশী দেশের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব সময়ই ভারসাম্য বজায় রেখে চলার চেষ্টা করেছে।
শ্রীলঙ্কায় গৃহযুদ্ধের সময় ভারত দ্বিমুখী ভূমিকা পালন করেছে, যা ছিল বহুল আলোচিত। দিল্লি কখনও তাদের তামিলনাডু রাজ্যের পক্ষ নিয়ে এলটিটিইকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়েছে। আবার গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কখনও কখনও অস্ত্র ও প্রশিক্ষণ দিয়ে শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছে।
অন্যদিকে পাকিস্তান শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করে তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদেরকে কার্যকর সহায়তা দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সফরের সময় পাকিস্তান প্রতিরক্ষা খাতে শ্রীলঙ্কাকে ৫ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। এরপর গত এপ্রিল মাসে দুই দেশের যৌথ সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হয়। ‘শেক হ্যান্ডস ওয়ান’ নামের এই যৌথ মহড়া দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যেকার নিরাপত্তা সম্পর্ককে আরও জোরদার করেছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামেও পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা একসাথে কাজ করছে। দুটি দেশই জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) সদস্য। ভারত ১৯৭৪ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর পর শ্রীলঙ্কা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য ছোট দেশের সাথে মিলে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত দক্ষিণ এশিয়া গড়ে তোলার জাতিসংঘ প্রস্তাবে সমর্থন জানায়।
শ্রীলঙ্কায় ২৫ বছর ধরে গৃহযুদ্ধ চলাকালে নিরাপত্তার অজুহাতে অন্য দেশগুলো সেদেশে তাদের ক্রিকেট টিমকে পাঠায়নি। কিন্তু পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড শ্রীলঙ্কায় তাদের ক্রিকেট টিমকে পাঠিয়ে দেশটির ক্রিকেটকে সমর্থন জানিয়েছে। তার প্রতিদান দিয়েছে শ্রীলঙ্কাও। পাকিস্তানে ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কান ক্রিকেট টিমের ওপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট বোর্ড পাকিস্তানে তাদের টিম পাঠানো অব্যাহত রাখে।
তামিল গেরিলাদের বিরুদ্ধে অভিযানকালে শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উঠে। এই অভিযোগ তদন্তে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলে বিভিন্ন সময়ে প্রস্তাব তোলা হয়েছে। পাকিস্তান সব সময়ই এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে এসেছে। এ কারণেই শ্রীলঙ্কা কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধে সব সময় নিরপেক্ষ থেকেছে।
কাশ্মীর নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক)-এর কার্যক্রমেও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এই দ্বন্দ্বে আটকা পড়েছে অন্য সদস্য দেশগুলোও। পাকিস্তান কাশ্মীরে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসী হামলায় সহায়তা করছে অভিযোগ তুলে ভারত ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিতব্য সার্ক শীর্ষ সম্মেলন বর্জন করে। ফলে বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভুটান সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কাও সম্মেলনে যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে সম্মেলন বাতিল হয়ে যায়। পরে অবশ্য শ্রীলঙ্কা বিবৃতি দিয়ে ২০১৭ সালে পাকিস্তানে সার্ক সম্মেলন অনুষ্ঠানের প্রতি সমর্থন জানায়।
মধ্য এশিয়ার সাথে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কানেক্টিভিটি বাড়াতে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরে (সিপিইসি) শ্রীলঙ্কাকে যুক্ত হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন পাকিস্তানের কর্মকর্তারা। পাকিস্তানের ভেতর দিয়ে এই ট্রানজিট রুট যাবে। তবে স্বল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তান মধ্য এশিয়ার সাথে আন্তঃমহাদেশীয় বাণিজ্যের জন্য সড়ক ও রেল যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে তুলতে কতটুকু সক্ষম হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তার চেয়ে বরং সিপিইসি-র আওতায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোনে বিনিয়োগ করলে শ্রীলঙ্কা বেশি লাভবান হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
পাকিস্তান-শ্রীলঙ্কার এই মৈত্রীর সম্পর্ক কতদূর সামনে এগিয়ে যাবে, তা নির্ভর করছে দুটি বিষয়ের ওপর। এর একটি হচ্ছে- বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সাথে শ্রীলঙ্কা তার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কে কিভাবে ভারসাম্য বজায় রাখবে। এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে- শ্রীলঙ্কার সাথে প্রতিরক্ষা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধির অঙ্গিকার পাকিস্তান কতটুকু রক্ষা করবে তার ওপর।