ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সময় মোটেও ভালো যাচ্ছে না। নানামুখী সংকট তাকে ঘিরে ধরেছে। করোনা মহামারির ধাক্কা সামলাতে তিনি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। এজন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাকে কঠোর সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। অন্যদিকে ফোনে আড়িপাতা যন্ত্র পেগাসাস কেনা নিয়ে তদন্ত ও সংশোধিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনে পার্লাামেন্ট অচল হয়ে পড়ে। এদিকে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন বাতিল করার পর গত এক বছরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই অঞ্চলটিতে সহিংসতার মাত্রা আগের চেয়ে আরও বেড়েছে। ফলে কাশ্মির পরিস্থিতিও মোদির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ১৯ জুলাই থেকে শুরু হওয়া পার্লামেন্টের বর্ষাকালীন অধিবেশন বিরোধী সদস্যদের প্রতিবাদের মুখে প্রতিদিনই কয়েকবার করে মুলতবি করতে হয়েছে। এর ফলে পার্লামেন্টের দুই কক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভায় সৃষ্টি হয় অচলাবস্থা। বিরোধী এমপিরা অভিযোগ করেছেন, পেগাসাস ও কৃষি বিল নিয়ে পার্লামেন্টে তাদেরকে কথাই বলতে দেওয়া হয়নি। কথা বলতে গেলেই তাদের মাইক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বর্ষাকালীন অধিবেশন শুরু হওয়ার আগের দিনই ফোনে আড়িপাতার যন্ত্র পেগাসাস ভারতে ব্যবহারের খবরটি মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়। এতে বিরোধীদলের সদস্যদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই যন্ত্রবিরোধী রাজনীতিক, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের ফোনের কথোপকথন রেকর্ড করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে বলে বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে। তারা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার ও সরকারকে ব্যাখ্যা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
ইসরাইলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ ফোনে আড়ি পাতার এই সফটওয়্যারটি উদ্ভাবন করেছে। এটি অত্যন্ত গোপনে মোবাইল ফোন ও অন্যান্য ডিভাইসে ইনস্টল করা সম্ভব। সফটওয়্যারটি অ্যান্ড্রয়েড এবং আইওএস দুই ধরনের মোবাইল ফোনেই ব্যবহার করে যে কোনো ব্যক্তির ফোনালাপ, ম্যাসেজসহ সবকিছুই জানা সম্ভব। এটির মাধ্যমে ফোন ট্র্যাকিং, কারও অবস্থান শনাক্ত করা, টার্গেট করা ব্যক্তির মাইক্রোফোন ও ক্যামেরায় প্রবেশ করা, পাসওয়ার্ড সংগ্রহ, কোনো অ্যাপ থেকে তথ্য সংগ্রহসহ আড়িপাতার অনেক কাজই করা যায়।
পেগাসাস ব্যবহার করার বিষয়ে সরকারকে ব্যাখ্যা দেওয়ার দাবিতে পার্লামেন্টের দুই কক্ষেই বিরোধীরা বিক্ষোভ করেন। তারা কাগজ ছিঁড়ে স্পিকার ও ট্রেজারি বেঞ্চের সদস্যদের দিকে ছুড়ে মারেন কয়েকবারই। ফলে পার্লামেন্টের স্বাভাবিক কাজে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এসব কারণে রাজ্য সভায় তৃণমূলের কয়েকজন সদস্যকে অধিবেশন থেকে সাসপেন্ডও করা হয়। কিন্তু তারপরও বিরোধী সদস্যরা তাদের বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। এ পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রাজ্যসভার চেয়ারম্যান উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু ও লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা।
বিষয়টি নিয়ে ভারতের পার্লামেন্টে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে চলেছে পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। সরকারি দলের অভিযোগ, বিরোধী এমপিরা অধিবেশন চালাতে দিচ্ছেন না। তারা প্রতিবাদ করতে পারেন, কিন্তু তারও একটা সীমা আছে। বিরোধীরা আলোচনায় না গিয়ে পার্লামেন্টকে অচল করে রাখার কৌশল বেছে নিয়েছেন।
কিন্তু বিরোধীরা বলেছেন, তাদের আলোচনায় যেতে না চাওয়ার অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। সরকার তাদেরকে আলোচনা করার সুযোগই দিচ্ছে না। পেগাসাস ইস্যু ও সংশোধিত কৃষি আইন নিয়ে কথা বলতে গেলেই তাদের মাইক বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পার্লামেন্টের ১৪টি বিরোধী দল একাট্টা হয়ে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, আগে পেগাসাস নিয়ে সরকারকে জবাবদিহি করতে হবে। তারপরে কৃষি আইন ও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
সংশোধিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে ভারতের কৃষকদের লাগাতার আন্দোলনও প্রায় এক বছর ধরে চলছে। আইনগুলো হচ্ছে- ‘কৃষি পণ্য লেনদেন ও বাণিজ্য উন্নয়ন বিল-২০২০’, ‘কৃষি পণ্যের দাম নিশ্চিত করতে কৃষকদের সুরক্ষা ও ক্ষমতায়ন চুক্তি বিল-২০২০’ এবং ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য (সংশোধনী) বিল-২০২০। কৃষকরা বলছেন, আইন তিনটি কার্যকর হলে তারা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন না। এ কারণে আইন তিনটি প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন থেকে সরবেন না। আর রাজ্য সরকারগুলো বলছে, আইনগুলো কার্যকর হওয়ার পর তাদের রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে।
দুই পক্ষই এই আইনের বিরোধিতা করার ফলে এটি নরেন্দ্র মোদির সরকারের জন্য একটি প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিস্থিতি সামলাতে সারাদেশের কৃষক সংগঠনগুলোর নেতাদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করে আইন সংশোধন করার প্রস্তাব দেওয়া হলেও কোনো ফল হয়নি।
সরকার গত বছর আগস্ট মাসে বিল তিনটি পার্লামেন্টে উত্থাপন করার পর কৃষকদের আন্দোলন শুরু হয়। তারা বিল তিনটি প্রত্যাহারের দাবি জানান। বিশেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের কৃষকরা এই বিল তিনটি প্রত্যাহারের দাবিতে রাজপথে নেমে আসেন। হাজার হাজার কৃষক দিনের পর দিন রাজপথে অবস্থান করতে থাকে। এমনকি এই আন্দোলন রাজধানী দিল্লিতেও এসে পৌঁছে। গত প্রায় এক বছর ধরে কৃষকদের এই আন্দোলন চলছে। ভারতে এর আগে কৃষকদের এত দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন আর দেখা যায়নি।
কিন্তু তারপরও সরকার তাদের দাবি মানেনি। সেপ্টেম্বর মাসে বিল তিনটি পার্লামেন্টের দুই কক্ষ লোকসভা ও রাজ্যসভায় পাশ হয়ে যায়। বিল পাশের সময় বিরোধী দলগুলো পার্লামেন্টে ব্যাপক প্রতিবাদ ও হট্টগোল করলেও তা শোনেনি সরকারি দল বিজেপি। সংখ্যাগরিষ্ঠাতার জোরে তারা বিল তিনটি পাশ করে নেয়। এরপর রাষ্ট্রপতি এই বিলে স্বাক্ষর করলে তা আইনে পরিণত হয়। দেশজুড়ে কৃষকদের বিক্ষোভ এবং বিরোধী দলগুলোর অনুরোধ উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপতি বিল তিনটিতে স্বাক্ষর করেন।
এতে কৃষকরা আরো বেশি ক্ষোভে ফেটে পড়েন। বিভিন্নস্থানে কৃষকদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষে প্রানহাণির ঘটনাও ঘটে। ক্ষুব্ধ কৃষকরা সরকারি সম্পত্তি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। শেষ পর্যন্ত বিষয়টি আদালতে গড়ায়। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট আইন তিনটি কার্যকরের উপর স্থগিতাদেশ দেন। একইসঙ্গে আদালত একটি কমিটি গঠন করে দেন। এই কমিটি সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাথে কথা বলে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পেশ করবে। কৃষি আইন তিনটি নিয়ে গত ৫ আগস্ট বুধবার সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হওয়ার কথা থাকলেও পরে তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী তারিখে আদালত কী সিদ্ধান্ত দেন সেদিকেই এখন সবার দৃষ্টি।
করোনা মহামারি মোকাবেলায় চরম ব্যর্থতার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে মোদির সযত্নে গড়ে তোলা “মোদি ব্র্যান্ড” বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেয়েছে। এজন্য মোদির বেশ কিছু পদক্ষেপই দায়ী।
করোনার ছোবল সত্ত্বেও নরেন্দ্র মোদি গঙ্গা নদীর তীরে হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব কুম্ভ মেলা আয়োজনের অনুমতি দিয়েছেন। লাখ লাখ হিন্দু কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানে সমবেত হয়েছেন পুণ্যস্নানের জন্য। এর ফলে করোনা মহামারির আরও বিস্তার ঘটেছে। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য বিধান সভার নির্বাচন করতে দিয়েছেন একমাস ধরে। সেই নির্বাচনের সময় মাস্ক না পরেই তিনি বড় বড় জনসভায় যোগ দিয়েছেন। এসব জনসভায় বিপুল জনসমাগম দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন বিশে^র বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। এ সম্পর্কে দ্য ইকনোমিস্টের ভারত প্রতিনিধি অ্যালেক্স ট্র্যাভেলি বলেছেন, ‘বিশে^র যেসব জায়গায় লকডাউন জারি করা হয়েছে সেসব জায়গার মানুষ ভারতে এরকম অসাবধানতা আর অবজ্ঞার প্রদর্শন দেখে হতবাক হয়েছেন।’
মোদি ব্র্যান্ডের ক্ষয় শুরু হয় ২০১৭ সালে। সে বছর তিনি ভারতীয় এক হাজার রুপির নোট বাতিল করে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনেন। এরপর গত বছর তিনি করোনার বিস্তার ঠেকাতে রাতারাতি লকডাউন জারি করেন। এর ফলে লাখ লাখ মানুষ কাজ হারায়। অনেকের জীবন যায় পথে-ঘাটে। ভারতের অর্থনীতি এখনও এই লকডাউনের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি।
আবার হুট করে লকডাউন তুলেও নিয়েছেন। ‘‘ভারতকে লকডাউন থেকে বের করে মোদি এক কোভিড কিয়ামতের দিকে নিয়ে গেলেন’’- ভারতে করোনা মহামারি পরিস্থিতি নিয়ে নরেন্দ্র মোদির ভূমিকার ব্যাপারে ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার সাম্প্রতিক শিরোনাম এটি। অস্ট্রেলিয়ার একটি সংবাদপত্রও একই খবর পুনঃপ্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে- ‘‘দম্ভ, উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতা মিলে ভারতে তৈরি সংকটে দেশটির নাগরিকদের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আর তার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী জনতার ভিড়ে আত্মপ্রসাদে মগ্ন।’’
করোনা মহামারি মোকাবেলায় ব্যর্থতা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সযত্নে লালিত ইমেজের ব্যাপক ক্ষতি করেছে। পরিস্থিতির ভয়াবহতার জন্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের খবরে সুনির্দিষ্টভাবে নরেন্দ্র মোদিকেই দায়ী করা হয়েছে। কেননা তিনি নিজেকে একজন দক্ষ প্রশাসক হিসেবে তুলে ধরে থাকেন। কিন্তু ভারতে প্রতিদিনই সংক্রমণের নতুন রেকর্ড গড়ার ফলে মোদির নেতৃত্বাধীন সরকারের কর্মকাণ্ডই প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
কেননা কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানার প্রায় দেড় বছর পরেও ভারতে করোনা সংক্রমণ খুব একটা কমেনি। এখনো দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৪২ হাজারের ওপরে রয়েছে। ভারতে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ১৮ লাখের ওপরে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনায় এ পর্যন্ত মারা গেছে ৪ লক্ষ ২৬ হাজার ২৯০ জন। দৈনিক মৃতের সংখ্যা ৫০০ জনের ওপরে রয়েছে। চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যা ৪ লক্ষ ২৬ হাজারের ওপরে। ফলে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে সরকারি মহলে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, করোনা মহামারি নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকটভাবে তুলে ধরেছে।