আফগানিস্তানে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন চার দশক আগে। অবশেষে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে বিশ্বের একক সুপার পাওয়ারের নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটকে পরাজিত করেছেন। নেতাকর্মীদের কাছে তিনি যেমন অতিপ্রিয়, তেমনি দলটির বৈশ্বিক মুখও তিনি। তিনি আর কেউ নন, তালেবানের রাজনৈতিক প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বারাদার। যিনি এক নিপুণ রণকৌশল প্রণেতা। যিনি একইসঙ্গে এরইমধ্যে কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মনে করা হচ্ছে, তিনিই হতে যাচ্ছেন দেশটির পরবর্তী ইসলামি শাসক।
মোল্লা আবদুল গনি বারাদার ১৯৬৮ সালে কান্দাহারে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মসূত্রে এই তালেবান নেতা একজন দুররানি পাশতুন। দুররানিরা আফগানিস্তানের আদি গোষ্ঠী। এঁদেরই পূর্বপুরুষ আহমেদ শাহ দুররানি আধুনিক আফগানিস্তান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
আবদুল গনি বারাদার ১৯৮০ এর দশকে সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে আফগান মুজাহিদিনদের লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে রাশিয়ানদের বিতাড়িত করার পর দেশটিতে বিভিন্ন যুদ্ধবাজদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় আবদুল গনি বারাদার তার সাবেক কমান্ডার মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের সঙ্গে কান্দাহারে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। মোল্লা ওমরের বোনকে বিয়ে করেছেন আব্দুল গনি বারদার। ফলে দুজনের মধ্যে রয়েছে আত্নীয়তার সর্ম্পক। পরে দুইজন মিলে প্রতিষ্ঠা করেন তালেবান আন্দোলন। যার নেতৃত্বে ছিলেন তরুণ ইসলামি পন্ডিতরা। ধর্মীয় বিশুদ্ধিকরণ এবং একটি ইসলামি আমিরাত সৃষ্টিই ছিল তাদের লক্ষ্য।
মোল্লা বা পন্ডিত উপাদি পেলেও আবদুল গনি বারাদারের পান্ডিত্য বা শিক্ষাগত যোগ্যতার তেমন কোনও সরকারি নথি পাওয়া যায় না। তবে তাঁর কৌশলের দক্ষতা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় স্বীকৃত। আমেরিকাকেও বোকা বানিয়ে দিয়েছেন তিনি।
তবে তিনি তালেবানের সর্বময় কর্তা বা প্রধান নেতা নন। কোনও দিনই ছিলেন না। সেই পদে রয়েছেন হাইবাতুল্লা আখুন্দজাদা। বরাবর দ্বিতীয় স্থানে কাজ করা আবদুল গনি বারাদারের ভূমিকা ছিল কৌশলপ্রণেতার। আড়ালে থেকে দলীয় প্রধানের প্রধান পরামর্শক হয়েই কাজ করেছেন তিনি। বহু বছর সেভাবে সামনে আসেননি। তবে প্রধান না হয়েও তালেবানের রাজনৈতিক অবস্থানের অভিমুখ তিনিই ঠিক করে দিয়েছেন। দেশে তো বটেই, এমনকি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও তার অবস্থানই ছিল তালেবানের শেষ কথা।
২০১৮ সালে আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন আবদুল গনি বারাদারের সঙ্গে কথা বলেই তালেবানের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছিল। তালিবান কম্যান্ডারের আশ্বাসেই আফগানিস্তান থেকে সেনাও সরিয়ে নেয় আমেরিকা। আমেরিকাকে আবদুল গনি বারাদার বুঝিয়েছিলেন, তালেবানও আফগানিস্তানে হিংসার বিরোধী। তারাও আসলে শান্তিই চায়। অবশেষে তালেবান সেনা আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভবনের দখল নেওয়ার পর তিনি বলেছেন, ‘এ তালেবানকে আসল পরীক্ষা এ বার দিতে হবে। দেশের মানুষকে প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে হবে তালেবানকে।’
আবদুল গনি বারাদার ছিলেন তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের সহযোদ্ধা। তালেবান প্রতিষ্ঠার ঠিক পাঁচ বছরের মাথাতেই তাদের সাফল্য আসে। ১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানের দখল নেয় তালবান। এবার যেভাবে কাবুল দখল করেছে তারা, ঠিক সে ভাবেই আফগানিস্তানে শুরু হয় তালেবান শাসন। সেই রাষ্ট্রেও আবদুল গনি বারাদার দায়িত্ব নেন আফগান সেনাদের। ২০০১ সালে মার্কিন সেনারা যখন আফগানিস্তান থেকে তালিবানকে উৎখাত করে, তখন বারাদার ছিলেন আফগানিস্তানের উপ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী।
পরে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে পাকিস্তানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বারাদর। সেখানেই তালেবানদের প্রশাসনিক সংগঠন কোয়েত্তা সুরা গঠন করেন। তার পর বহু বার তালেবানের তরফে বোঝাপড়ার বার্তা নিয়ে আফগান প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলেছেন আবদুল গনি বারাদার।
সাবেক আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সঙ্গে আলোচনা অনেক দূর এগিয়েছিল। একটা সময়ে বারাদারকে তালেবানের ‘শান্তির মুখ’ হিসবে দেখতে শুরু করে আন্তর্জাতিক দুনিয়াও।
২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসনে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হলে ২০ বছর নির্বাসনে ছিলেন আবদুল গনি বারাদার। তিনি অত্যন্ত সূক্ষ্ম রাজনৈতিক অপারেটর হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পশ্চিমা কূটনীতিকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
বারাক ওবামা প্রশাসন অবশ্য তার সামরিক দক্ষতায ভীষণ ভয় পেয়েছিল। তিনি দীর্ঘদিন পাকিস্তানের করাচিতে আত্মগোপনে ছিলেন। সিআইএ ২০১০ সালে তার অবস্থান জানতে পারে। পরে পাকিস্তানের আইএসআই তাকে গ্রেপ্তার করে। আন্তর্জাতিক মহলের একাংশ তখন বলেছিল এই গ্রেফতারির নেপথ্যে আমেরিকারই নির্দেশ রয়েছে।
২০১৮ সালে ওয়াশিংটনের মনোভাব পরিবর্তিত হয় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের আফগান দূত জালমে খলিলজাদ তাকে মুক্তি দিতে বলেন, যাতে তিনি কাতারে শান্তি আলোচনার নেতৃত্ব দিতে পারেন। আমেরিকা মনে করেছে, তাকে ছাড়া আফগানিস্তানে ক্ষমতা ভাগাভাগি ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে না।
আবদুল গনি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দোহা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন। ট্রাম্প প্রশাসন ওই চুক্তিকে শান্তির জন্য একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে প্রশংসা করেছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে সেটা ছিল তালেবানদের বিজয়ের চুক্তি।
এই চুক্তিতে তালেবানদের ক্ষমতা সংক্রান্ত সমঝোতায় আসার সুযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল আমেরিকা। সঙ্গে আফগানিস্তান থেকে ন্যাটো বাহিনীকে সরিয়ে নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয় আমেরিকার পক্ষ থেকে।
সে সময় অনেকেই এই চুক্তি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ এই পদক্ষেপের প্রশংসাও করেন। অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেন, আবদুল গনি বারাদার আসলে ওই চুক্তি সই করেছিলেন সময় পাওয়ার জন্য। যত দিনে আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সেনা সরিয়েছে, অপরদিকে ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিয়েছে তালিবান। সেনা সরলেই আক্রমণ করবে বলে।
ওই চুক্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবান পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করার অঙ্গীকার করেছিল। চুক্তিতে তালেবাকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকা থেকেও বাদ দেয়ার অঙ্গীকার করে আমেরিকা।
কথা ছিল এরপর তালেবান এবং আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা হবে। তবে সইে আলোচনায় সামান্যই অগ্রগতি হয়েছিল। আশরাফ গনি ক্ষমতা ভাগাভাগিতে রাজি ছিলেন না।
তালেবানরাও জানতো মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান ছাড়লে প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি টিকতে পারবেন না। এটা এখন স্পষ্ট যে আবদুল গনি বারাদার এবং তালেবান মোক্ষম সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। তারা আমেরিকানদের চলে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিল এবং চূড়ান্ত আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
অবশেষে মার্কিন সেনা পুরো প্রত্যাহারের আগেই ঝড়ের গতিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করে নেয়। আর কাবুল দখল করতে তাদের একটি গুলিও ছুড়তে হয়নি। আমেরিকা ভিয়েতনামের মত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে তল্পিতল্পা নিয়ে আফগানিস্তান ছেড়েছে। আর প্রেসিডেন্ট গনি গোপনে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।
দীর্ঘ লড়াইয়ে আবদুল গনি বারাদার অসীম ধৈর্য আর সুনিপুণ রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছেন। অবশেষে বিজয়ের মুকুট এখন তারই প্রাপ্য।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, তালেবানের রণকৌশল বহুযুগ ধরে বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করবে, সফল বিপ্লবের পথ দেখাবে।
প্রথমবারের তালেবান সরকার ছিল অনেকটা অপরিপক্ক ও অদূরদর্শী। দেশ পরিচালনার কোনো অভিজ্ঞতাও তাদের ছিল না। নারীদের ব্যাপারে তাদের কঠোর নীতিও বিশ্বের নিন্দা কুড়ায়।
কিন্তু এবারের তালেবান অনেক বেশি পরিপক্ব ও দূরদর্শী। আন্তর্জাতিক কূটনীতির খেলায়ও তারা বেশ ঝানু হয়ে উঠেছে। কাবুল দখল করলেও একটিও প্রাণহানি ঘটায়নি তালেবান যোদ্ধারা। তালেবান নেতৃত্ব ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনার যে প্রাথমিক রূপরেখা দিয়েছে তাতে তারা বেশ উদারতার পরিচয় দিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, এসবের পেছনে আছেন আবদুল গনি বারাদারের ঠান্ডা মাথার হিসাব। প্রেসিডেন্ট হলে আবদুল গনি যে দেশের নেতৃত্ব দেবেন, তার নাম হবে ‘ইসলামিক এমিরেটস অব আফগানিস্তান’। তিনি এই দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। এর জন্য তার বহু সহযোগী জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।