চীনের প্রভাব ঠেকাতে মিয়ানমারের সেনাশাসকের সাথে ঘনিষ্ট সর্ম্পক গড়ে তোলে ভারত। নির্বাচন বাতিল করে সেনাবাহিনী মিয়ানমারের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রন নেয়ার পর নয়াদিল্লি নিশ্চুপ ছিলো। পশ্চিমা দেশগুলো যখন মিয়ানমারের ওপর নানা ধরনের অবরোধ আরোপ করছে তখন মিয়ানমারের সাথে বানিজ্য ও সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়েছে ভারত। কিন্তু এই সর্ম্পকে এখন ফাটল ধরেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এর কারন মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব ভারতের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্স বা পিডিএফ। এদের সমর্থন দিচ্ছে পশ্চিমা দেশগুলো। মিয়ানমার মনে করছে ভারতের সমর্থন আছে পিডিএফের ওপর। ফলে উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীদের সমর্থন দিতে শুরু করেছে মিয়ানমার। ফলে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল আবার অস্থির হয়ে উঠতে শুরু করেছে। এশিয়া টাইমসের বিশ্লেষনের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন হায়দার সাইফ।
ভারতের জাতিগত যোদ্ধাদেরকে আশ্রয় দিয়ে নয়াদিল্লিকে চাপে ফেলার কৌশল নিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা তাতমাদাও। মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য গঠিত হয়েছে পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বা পিডিএফ। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পিডিএফের সদস্যদের উপর হামলা করছে। আর বিনিময়ে তাদেরকে নিরাপদ আশ্রয় দিচ্ছে মিয়ানমার সেনবাহিনী।
১৩ নভেম্বর ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের মনিপুর রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী বিদ্রোহীরা ভয়াবহ হামলা চালায়। হামলায় আসাম রাইফেলস আধাসামরিক ইউনিটের কমান্ডিং অফিসার, তার স্ত্রী, তাদের ছয় বছর বয়সী ছেলে এবং আরও চারজন রাইফেলম্যান নিহত হয়। তারা যে গাড়ি বহরে করে যাচ্ছিলেন, সেই বহরে হঠাৎ হামলা করে পিপলস লিবারেশান আর্মি বা পিএলএ এবং মনিপুর নাগা পিপলস ফ্রন্ট বা এমএনপিএফের বিদ্রোহীরা। এই হামলা ভারত-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। এই দুটো বিদ্রোহী গ্রুপেরই মিয়ানমার সীমান্তের কাছে ক্যাম্প রয়েছে। কিছু প্রতিবেদনে জানা গেছে, ভয়াবহ ওই হামলা চালানোর পর তারা সম্ভবত মিয়ানমারের ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নেয়।
এই হামলার পর ভারতের নিরাপত্তা বাহিনী অতিমাত্রায় সর্তক হয়ে উঠে। এরপর নাগাল্যান্ড রাজ্যের মন জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১৪ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। মন জেলায় বিদ্রোহীদের সম্ভাব্য চলাচলের খবর পেয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স অভিযান চালায়। তিরু-ওতিং সড়কে গ্রামবাসীদের বহনকারী একটি ট্রাকে হামলা চালায় তারা। এতে ছয় গ্রামবাসী নিহত হন। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুই জনের মৃত্যু হয়।
ওই ঘটনার পর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ঘিরে ফেলেন ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা। তখন নিরাপত্তা বাহিনী গ্রামবাসীর ওপর গুলি চালালে আরও ৫ গ্রামবাসী নিহত এবং ৬ জন আহত হন। এই ঘটনায় এক সেনাসদস্য নিহত হন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর তিনটি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা আসাম রাইফেলস ক্যাম্প ঘিরে ফেললে মন শহরের পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। পুলিশ জানিয়েছে, বিক্ষোভকারীরা ক্যাম্পে ঢুকে পড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ভারতের সাথে মিয়ানমারের ১৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সীমান্তের অধিকাংশ জায়গা দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল। তাই সেটা পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। ফলে বিদ্রোহী যোদ্ধারা খুব সহজেই যে কোন হামলা চালিয়ে সীমান্তের ওপারে পালিয়ে যেতে পারে।
উত্তরপূর্ব ভারতের জাতিগত নাগা, মনিপুরি, আর আসামের বিদ্রোহীরা বহু বছর ধরে মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে ঘাঁটি গড়ে তুলেছে। সেখান থেকে তারা প্রায়ই ভারতীয় বাহিনীর উপর হামলা চালায়। হামলার পর আবার তারা সীমান্তের ওপারে চলে যায়। ভারত-মিয়ানমারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের এই আশ্রয় ক্যাম্পগুলো সবসময় উত্তাপ ছড়িয়েছে। তবে মিয়ানমার সাধারণত এই বিদ্রোহীদের ব্যাপারে নীরব ছিল। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে তাদের এই নীতিতে হঠাৎ পরিবর্তন দেখা যায়। সেই সময় তাতমাদাও ভারতীয় বিদ্রোহীদের একটি প্রধান ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে সেটি গুড়িয়ে দেয়।
তাতমাদাওয়ের ওই অভিযানে সাগাইংয়ের উত্তরাঞ্চলে টাগা এলাকার মূল সদরদপ্তর থেকে উৎখাত হয় নাগা, মনিপুরি, আর আসামের বিদ্রোহীরা। এই অভিযানে ভারত আর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল।
ওই সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি দুই দেশের মধ্যে অস্ত্র চুক্তিও হয়েছে। তাতমাদাও এখন আবার আগের জায়গায় ফিরে গেছে বলে মনে হচ্ছে। মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা শুধু অবস্থান করছে না মিয়ানমার আর্মি-বিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সেস বা পিডিএফের উপর হামলার জন্যে তাদেরকে ব্যবহারও করছে।
মনিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতি জনগোষ্ঠির বিদ্রোহীরা সাগাইং অঞ্চলের তামু এলাকায় পিডিএফের উপর হামলার খবর এসেছে। এশিয়া টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তামু এলাকাটির অবস্থান ভারতের মনিপুরের মোরেহ এলাকার বিপরীতে। এই হামলার প্রতিদান হিসেবে ভারতের বিদ্রোহীদের মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে আশ্রয় নেয়ার সুযোগ দিয়েছে তাতমাদাও।
ধারণা করা হচ্ছে, জাতিগত চিন বা মিজো গোষ্ঠির মানুষদের নিয়ে জোমি রেভল্যুশনারি আর্মি গঠন করা হয়েছে। এই ধরণের প্রক্সি বাহিনীর ব্যবহার তাতমাদাও নিশ্চিতভাবে আরও বাড়াবে। কারণ তাতমাদাওয়ের নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের উপর চাপ অনেক বেড়ে গেছে। সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের স্বাভাবিক শান্তিপূর্ণ অঞ্চলগুলোও যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নিয়মিত সেনা সদস্যদেরকে সেখানে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।
রেভল্যুশনারি পিপলস ফ্রন্ট বা আরপিএফের সশস্ত্র শাখা পিএলএ সেই ১৯৭০-এর দশক থেকেই মেইতিদের মধ্যে সক্রিয়। এই বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল মূলত চীনারা। তিব্বতের রাজধানী লাসার কাছের এক সামরিক ক্যাম্পে তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মনিপুরের মেইতি-অধ্যুষিত ইমফাল উপত্যকায় পিএলএ বেশ কতগুলো হামলা চালিয়েছে। পরে তারা বেশ কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। আর মূল গ্রুপের বাকি অংশ মিয়ানমার সীমান্তের কাছে আশ্রয় নেয়।
আরপিএফ বা পিএলএ ছাড়াও মেইতিদের আরও কিছু বিদ্রোহী গ্রুপ আছে। এর মধ্যে রয়েছে পিপলস রেভল্যুশনারি পার্টি অব কাংলেইপাক বা প্রেপাক, ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশান ফ্রন্ট, এবং কাংলেইপাক কমিউনিস্ট পার্টি। সবগুলো মেইতি বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর একটা অভিন্ন সমাজবাদী এজেন্ডা রয়েছে। সেটা হলো মনিপুরিকে ভারত থেকে স্বাধীন করা। এমএনপিএফ জাতিগত নাগা গেরিলাদের একটি ছোট গ্রুপ। নাগাদের যে মূল সংগঠন রয়েছে, সেটা হলো ন্যাশনাল সোশালিস্ট কাউন্সিল অব নাগাল্যান্ড বা সংক্ষেপে নাগালিম। এমএনপিএল নাগালিমের বাইরে আলাদাভাবে সক্রিয় রয়েছে। এই গ্রুপটিও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় বহুদিন ধরে আশ্রয়ে আছে।
সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমার আবারও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তাদের বিদেশী মিত্র এখন হাতে গোনা। রাশিয়া তাদের মিত্রদের মধ্যে অন্যতম। কিন্তু রাশিয়ার আগ্রহ মূলত বাণিজ্যের দিকে। কারণ রাশিয়ান অস্ত্রের অন্যতম প্রধান ক্রেতা হলো মিয়ানমার। মিয়ানমারে চীনের বড় ধরণের ভূকৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই-এর সাথে এই স্বার্থ জড়িত। এই বিআরআইয়ের অগ্রগতি ঠেকানোর জন্যেই মূলত ভারত মিয়ানমারের অভ্যুত্থানের প্রকাশ্য সমালোচনা করেনি। তাদের আশঙ্কা হলো, দিল্লির সমালোচনার কারণে মিয়ানমার ভারতের থেকে দূরে সরে যাবে, এবং বেইজিং সেটাকে কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক উচ্চাকাঙ্খা পূরণ করবে।
২৪ জুলাই অপরচুনিটিজ অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেস ইন নর্থ ইস্ট ইন্ডিয়া শীর্ষক এক সামরিক ওয়েবিনারে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ জেনারেল বিপিন রাওয়াত। সেখানে তিনি প্রকাশ্যেই ভারতের এই আশঙ্কার কথা বলেছিলেন।
রাওয়াত বলেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতির উপর ভারতকে গভীরভাবে নজর রাখতে হবে। কারণ পহেলা ফেব্রুয়ারির সামরিক অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল হওয়ায় চীন সেখানে আরও সুবিধা করে নিচ্ছে। তার ভাষায়, মিয়ানমারের উপর নিষেধাজ্ঞার কারণে চীনের বিআরআই নিশ্চিতভাবে আরও এগিয়ে যাবে।
মিয়ানমারের সামরিক অভ্যুত্থানের ঠিক পরপরই ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান মনোজ মুকুন্দ নারাভানে পরোক্ষভাবে তাদের প্রশংসাও করেছিলেন। তিনি বলেন, তাতমাদাওয়ের সাথে ভারত যে সব ধারাবাহিক অভিযানে অংশ নিয়েছে, সেগুলো দুই দেশের সেনাদের মধ্যে সহযোগিতা ও সমন্বয় বাড়িয়ে দিয়েছে। মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে ২৭ মাচ সামরিক জান্তা যখন সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন করে, তখন ভারত সেখানে সামরিক অ্যাটাশেকে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়েছিল। অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া অন্য প্রতিনিধিরা এসেছিলেন চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, লাওস এবং থাইল্যান্ড থেকে।
ভারত আর মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের উপর মনিপুর হামলার কি প্রভাব পড়ে, সেটাই এখন দেখার বিষয়। ভারত হয়তো ২০১৯ সালের আগের মতো পারস্পরিক সন্দেহের সম্পর্কে ফিরে যেতে চাইবে না। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠিগুলোর সাথে তাতমাদাওয়ের যে সম্পর্ক হয়েছে তা ভারতের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকির কারন হয়ে দেখা দেবে। উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীরা যদি মিয়ানমারের জোরালো সমর্থন পায় তা হলে উত্তর পূর্ব ভারত অস্থির হয়ে উঠবে। ইতোমধ্যে তার আলামত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
উত্তর পূর্ব ভারতের বিদ্রোহীরা শুধু মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থান করছে এমন নয় চীনের মধ্যে এই সব বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর উপস্থিতি রয়েছে। ভারতের নিরাপত্তা সংস্থাগুলো তা ভালো করেই জানেন। এ চীনের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বিদ্রোহীরা হয়তো সরাসরি কোন সহায়তা পাচ্ছে না। তবে, চীনের পশ্চিম ইউনানের রুইলিসহ অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় পিএলএ, প্রেপাক, এবং ইউনাইটেড লিবারেশান ফ্রন্ট অব অসম বা উলফার মতো গ্রুপগুলোর প্রতিনিধি রয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন বেইজিং নিশ্চিতভাবে উত্তপুর্ব ভারতের ঘটনাপ্রবাহের উপর কড়া নজর রাখছে। ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলে এমনিতেই সব সময় উত্তেজনা থাকে। সেটা যদি আরও বেড়ে যায়, তা নিশ্চিতভাবে চীনের কৌশলগত স্বার্থের জন্য অনুকূল যাবে।
এখন মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তাতমাদাও ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সাথে জড়িয়ে গেছে। পিডিএফের বিরুদ্ধে হামলার পুরস্কার হিসেবে তারা ভারতের বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে অবাধে চলাফেরার সুযোগ দিচ্ছে। এই দিকটি বিবেচনা করলে মনে হয় ভারত-মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো হয়তো আগের পরিস্থিতিতে ফিরে যাচ্ছে। এবারই প্রথমবারের মতো তাতমাদাও ভারতের বিদ্রোহী গ্রপগুলোর সাথে খোলামেলা সহযোগিতার সম্পর্ক গড়েছে। তাদের এই পদক্ষেপের কারণে ভারতের অগ্নিগর্ভ উত্তরপূর্বাঞ্চলে সম্পূর্ণ নতুন নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।