মোদির পর আসছেন যোগি!

মুসলিমবিদ্বেষী যোগী আদিত্যনাথ হচ্ছেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী ? - ছবি : সংগ্রহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ২১:০৫

ভারতে ২০২৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী কি হতে যাচ্ছেন উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের কট্টর মুসলিম বিদ্বেষী মূখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ? নরেন্দ্র মোদির পরে তিনিই কি ভারতের প্রধানমন্ত্রী আসনে বসতে যাচ্ছেন? সে রকম সম্ভাবনার কথাই জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে।  ২০২০ সালে ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার এক জরিপে যোগী আদিত্যনাথকে ভারতের সবচেয়ে সফল মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশ্লেষণেও যোগী ২০২৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন বলে আভাস দেয়া হয়েছে।

 

ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশে বিধান সভার নির্বাচন ১০ ফ্রেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। ৭ দফায় এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মার্চ মাসের প্রথম দিকে নির্বাচনের ফল প্রকাশ করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্যে বিজেপি সরকারের মূখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ও বক্তব্যের কারণে এবার বিজেপির আসন কমবে বলে সম্প্রতি প্রকাশিত বিভিন্ন জরীপের ফলাফলে বলা হয়েছে। তারপরও এই নির্বাচনে বিজেপিই জিতবে বলে কোন কোন জরীপে আভাস দেয়া হয়েছে।

বিজেপি’র প্রতি ৪৩ শতাংশ জনসমর্থন রয়েছে বলে জরিপে বলা হয়েছে। জিতলে কট্টর মুসলিমবিদ্বেষী বর্তমান মূখ্যমন্ত্রী যোগি আদিত্যনাথই দ্বিতীয় বারের মতো মূখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসবেন। তার এই বিজয় ২০২৪ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে তাকে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে বলে ক্ষমতাসীন দলটির নেতারা বলছেন। বিজেপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পরে দলের মধ্যে যোগী আদিত্যনাথকেই প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য যোগ্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। মোদির পরে তিনিই এগিয়ে আছেন।

সে ধরণের কিছু ঘটলে তা ভারতের মুসলমানদের জন্য আরো বড় বিপদ বয়ে আনবে বলে মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক। কারণ যোগী আদিত্যনাথের মুসলিম বিদ্বেষী মনোভাব গোপন কিছু নয়। তিনি দীর্ঘ দিন ধরেই ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে নানা তীর্যক মন্তব্য করে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে ভারতের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যে দমন অভিযান শুরু হয়েছে যোগি আদিত্যনাথ প্রধানমন্ত্রী হলে- তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

যোগি আদিত্যনাথের প্রকৃত নাম অজয় সিং বিস্ত। জন্ম ১৯৭২ সালের ৫ জুন বর্তমান উত্তরাখণ্ড রাজ্যের গৌরিবাল জেলার পঞ্চুর গ্রামের একটি রাজপুত পরিবারে। তার পিতা আনন্দ সিং বিস্ত ছিলেন একজন ফরেষ্ট রেঞ্জার। যোগী উত্তরাখণ্ডের হেমবতী নন্দন বহুগুনা গড়বাল বিশ্ববিদ্যালয় গণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেছেন। ছাত্র থাকার সময় তিনি উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএস এর ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন।

অযোধ্যার রাম মন্দির আন্দোলনে যোগ দিতে যোগি ১৯৯০ সালের দিকে বাড়ি ছেড়েছিলেন। এরপর এক সময় তিনি উত্তরপ্রদেশের গোরখনাথ মঠের মূখ্য পুরোহিত মহন্ত অবৈদ্যনাথের সংস্পর্শে আসেন ও পরে তার শীষ্য হন। পরবর্তী সময়ে তার নাম দেয়া হয় যোগী আদিত্যনাথ । তিনি মহন্ত অবৈদ্যনাথের উত্তরাধিকারি মনোনীত হন। ২০১৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর মহন্ত অবৈদ্যনাথের মৃত্যুর পর যোগী আদিত্যনাথকে গোরখনাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবে পদোন্নতি দেয়া হয়।

নানা ধরণের বিতর্কিত মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে সমালোচনার অন্ত নেই। রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই বিতর্কিত মন্তব্য করে আসছেন তিনি। বলিউড কিং শাহরুখ খান থেকে শুরু করে ভারতের সব মুসলমানদের নিয়েই তিনি সব সময় তির্যক মন্তব্য করেন।

২০০৫ সালে একটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, যোগী আদিত্যনাথ ‘পরিশোধন অভিযান’ নামে একটি সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। এই সংগঠনটি উত্তর প্রদেশে প্রায় ১৮০০ খ্রিষ্টানকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত ছিল। সে সময় যোগী আদিত্যনাথ বলেছিলেন, উত্তরপ্রদেশ এবং পুরো ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত না করা পর্যন্ত তিনি থামবেন না। ২০১৫ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় মুসলিম প্রধান ৬ দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করলে যোগী আদিত্যনাথ ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করে বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় ভারতেরও উচিত এমন পদক্ষেপ নেয়া।

যোগী আদিত্যনাথ ১৯৯৮ সালে মাত্র ২৬ বছর বয়সে উত্তর প্রদেশের গোরখপুর আসন থেকে প্রথমবারের মতো লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসন থেকে তিনি টানা ৫ বার লোকসভা সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। উত্তর প্রদেশে ২০১৭ সালের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয় পায় কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি।

বিধান সভায় দলের নেতা নির্বাচিত হন কট্টর হিন্দুত্ববাদী ও মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত পুরোহিত যোগী আদিত্যনাথ। তিনি সব সময়ই মুসলিম বিরোধী কথা বলে সারা ভারতেই ব্যাপক পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। তার নির্বাচনী প্রচারণার সময়ও তিনি অনবরত মুসলিম বিরোধী কথাবার্তা বলে থাকেন। তিনি এক জনসভায় বলেছেন, রাজ্যের সমাজবাদী পার্টির সরকার উন্নয়ন করেছে শুধু কবরস্থানগুলোর; কিন্তু বিজেপি ক্ষমতায় এলে রাম মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করবে। এর আগে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তিনি বলেন, যেখানে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা কেউ আটকাতে পারেনি, সেখানে মন্দির তৈরি করা কে আটকাবে?

২০১৬ সালে যোগীর আরেকটি বিতর্কিত মন্তব্য ছিল ঈদুল আযহা বা কোরবানীর ঈদকে ঘিরে। সেসময় তিনি বলেছিলেন, মূর্তি বিসর্জন দেয়ার সময় সবার মনে হয় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, কিন্তু ঈদুল আযহার দিনে যে হাজার হাজার নিরীহ পশু কেটে ফেলে হয় কাশীতে, ওইসব পশুর রক্ত যখন সরাসরি গঙ্গায় গিয়ে পড়ে তখন পরিবেশ দূষণ হয় না?

২০১৫ সালে যোগ ব্যায়াম করা নিয়ে তার একটি মন্তব্য ছিল এরকম- যারা যোগব্যায়ামের বিরোধিতা করছে তাদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। সূর্য নমস্কারকে কেউ যদি সম্মান দিতে না পারে, তার সমুদ্রে ডুবে মরা উচিত। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে তার সবচেয়ে বিতর্কিত মন্তব্য মসজিদকে নিয়ে। তিনি বলেছিলেন, যদি অনুমতি পাই তাহলে দেশের প্রত্যেকটি মসজিদে গেীরি-গনেশের মূর্তি স্থাপন করে দেব। আর্যাবর্তে আর্যরা তৈরি হয়েছিলেন, হিন্দুস্তানকে আমরা হিন্দু করে দেব। পুরো পৃথিবীতে গেরুয়া ঝাণ্ডা উড়বে।

মূখ্যমন্ত্রীর আসন বা পদ যোগী আদিত্যনাথকে এ ধরণের বিতর্কিত কথা বলা থেকে বিরত রাখতে পারেনি। তিনি তার উগ্র হিন্দুত্ববাদী তৎপরতা জোরদার করার জন্য হিন্দু যুব বাহিনী নামে একটি কট্টরপন্থী সংগঠনও গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনের সদস্যরা সব সময়ই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিল। মুসলমানরা গরু জবাই করলে তাদের উপর নির্যাতনও করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে। কেননা হিন্দুরা গরুকে পবিত্র হিসেবে গণ্য করে এগুলো রক্ষার জন্য সব সময় তৎপর ।

এবারের বিধানসভা নির্বাচনী প্রচারণার সময়েও যোগী মুসলমানদের কটাক্ষ করে নানা কথা বলেছেন। উত্তরপ্রদেশের ২০ কোটি মানুষের এক পঞ্চমাংশ অর্থাৎ ২০ শতাংশ হচ্ছে মুসলমান। যোগী মুসলমানদের উদ্দেশ্য বলেছেন, এবারের নির্বাচন হবে ৮০ শতাংশ বনাম ২০ শতাংশের মধ্যে।

যোগীর শাসনামলে বিভিন্নভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন ও হয়রানীর শিকার মুসলমানরা রাজ্যের অখিলেশ যাদেবের সমাজবাদী পার্টিকে ভোট দেবে বলে জনমত জরীপের ফলাফলে আভাস দেয়া হয়েছে। যোগী তার বক্তব্যে সে বিষয়টিই বুঝাতে চেয়েছেন। 

যোগী আদিত্যনাথ সম্পর্কে নিজের মূল্যায়নে ভারতের সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুনীতা আ্যারোন বলেন, যোগী যে উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও আদর্শ লালন করেন তা প্রকাশে তিনি কোন রাখঢাক করেন না। তিনি নিজেকে একজন হিন্দু নেতা হিসেবে তুলে ধরতেই পছন্দ করেন। ফলে তার জনসভায় লোক সমাগম যেমন বেশি হয় তেমনি তিনি ভোটও বেশি পান।

সুনীতা আ্যারোন আরো বলেন, যোগী যখন মুসলমানদের বিরদ্ধে কথা বলেন, তাদের সম্পর্কে তীর্যক মন্তব্য করেন তখন দর্শক-শ্রোতারা খুশি হয়। সম্প্রতি এক নির্বাচনী জনসভায় যোগী ভারতের মুসলমানদের সম্পর্ক বলেছেন, তারা তো পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্নাহকে পূজা করে। সেজন্য পাকিস্তানই তাদের কাছে প্রিয়; কিন্তু আমরা ভারতের জন্যই আমাদের জীবন উৎসর্গ করেছি।

বিভিন্ন সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড বিশেষ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক উস্কানীমূলক বক্তব্য দেয়ার জন্য যোগীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন আদালতে বেশ কয়েকটি ফৌজদারি মামলাও রয়েছে। ২০০৭ সালে তিনি এজন্য ১১ দিন জেলও খেটেছেন। ঐ সময় তিনি বলেছিলেন, মুসলমানরা যদি একজন হিন্দুকে হত্যা করে তাহলে আমরা ১০০ জন মুসলমানতে হত্যা করব; কিন্তু এ ধরণের বক্তব্য দেয়ার পরও যোগীর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনে আরো উন্নতি হয়েছে। তিনি ২০১৪ সালে মঠের প্রধান পুরোহিত হয়েছেন। ২০১৭ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।