ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সেভেন-সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্য একসময় স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠিগুলোর তৎপরতায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে এই বিদ্রোহ দমন করতে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এই সাতটি রাজ্যের একটি হচ্ছে মনিপুর। রাজ্যের প্রধান জনগোষ্ঠী হিন্দু মেইতেইদের সাথে খ্রিস্টান উপজাতীয় কুকিদের নতুন করে সংঘাতে এই রাজ্যে চরম অস্থিরতা চলছে গত প্রায় দুই মাস ধরে। এই সংঘাতে এ পর্যন্ত অন্তত ১২৫ জন নিহত ও কয়েকশ মানুষ আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে আছেন প্রায় সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষ। আছেন সেনা সদস্যও। তবে কুকিদের সংখ্যাই বেশি। ঘরবাড়ি-ছাড়া হয়েছেন ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। এদের মধ্যে অনেকেই পাশের রাজ্য মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছেন। সংঘর্ষ থামাতে দুই পক্ষের মধ্যে বেশ কয়েকদফা শান্তি আলোচনা হলেও তাতে কোনো সমাধান আসেনি।
মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করলেও বিবদমান পক্ষগুলো প্রতিবেশী মিয়ানমার থেকে সাহায্য পাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। এ-নিয়ে ভারতের নীতিনির্ধারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। মণিপুরের এই অস্থিরতা ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
মণিপুরের দুই প্রভাবশালী গোষ্ঠী মেইতেই ও কুকিদের মধ্যে বিরোধ দীর্ঘদিনের। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায়ের। এদের অনেকেই বৈষ্ণব। রাজ্যের নিচু এলাকা বা সমতলের বেশিরভাগ মেইতেইদের নিয়ন্ত্রণে। সমতল বলতে রাজধানী ইম্ফল ও আশপাশের এলাকা।
অন্যদিকে রাজ্যের মোট বাসিন্দার ১৬ শতাংশ কুকিসহ বিভিন্ন ছোট ছোট জো-জনগোষ্ঠীর। প্রায় এক ডজন জো-জাতির মধ্যে কুকিরাই আকারে বড়। নাগাদের সংখ্যা ২৪ শতাংশ। মুসলমান আছে প্রায় ১০ শতাংশ। নাগা এবং কুকিসহ ৩৩টি উপজাতীয় গোষ্ঠীর বসবাস রাজ্যের ৯০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে। তাদের একটা বড় অংশ খ্রিস্টান। এসব উপজাতি তফসিলি উপজাতি বা এসটি হিসেবে সরকারের কাছ থেকে চাকরি ও শিক্ষাখাতে কোটাসহ নানা সুবিধা পায়।
ভারতে যে-সব সম্প্রদায় ঐতিহাসিকভাবে সমান সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে, তাদেরকে তফশিলি উপজাতি বা এসটি শ্রেণিভুক্ত করে তাদের জন্য সরকারি চাকরি, কলেজে ভর্তি ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির আসন সংরক্ষণ করা হয়। এই সুবিধা পেতে গত কয়েক বছর ধরেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্য মণিপুরের মেইতেই সম্প্রদায় দাবি জানিয়ে আসছিল। এরপর গত মে মাসে মণিপুর হাইকোর্ট রাজ্য সরকারকে মেইতেই সম্প্রদায়ের দাবি বিবেচনার নির্দেশ দেয়।
রাজ্যের কুকি ও নাগাসহ অন্য উপজাতির লোকেরা হাইকোর্টের এই আদেশের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের মধ্যে এই উদ্বেগ সৃষ্টি হয়, মেইতেইদেরকে এসটি মর্যাদা দেওয়া হলে সরকারি চাকরির জন্য তাদেরকে মেইতেইদের তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে হবে। এই আতঙ্ক থেকেই তারা আন্দোলনে নামে। গত ৩ মে উপজাতীয় ছাত্র সংগঠন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব মণিপুর’-এর কর্মসূচি ঘিরে অশান্তির সূত্রপাত হয়। মেইতেইদের সাথে সহিংস সংঘাত শুরু হয় কুকিসহ অন্য উপজাতীয়দের।
ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি দেশটির একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মেইতেইদেরকে তফশিলি উপজাতীয় হিসেবে গণ্য করে তাদেরকে অন্যদের মতো সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদানের একটি আদেশ দিয়েছেন আদালত। এ-বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ও মণিপুর রাজ্য সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।
মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতিকে গৃহযুদ্ধবিধ্বস্ত লেবানন, সিরিয়া, নাইজেরিয়া এবং লিবিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল এল নিশিকান্ত সিংহ। আনন্দবাজার পত্রিকা ও ইন্ডিয়া টুডে-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মণিপুরের বাসিন্দা সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা গত ১৯ জুন তার এক টুইটে বলেন, ‘আমি মণিপুরের একজন অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। সাধারণ ভারতীয়ের মতোই অবসর জীবনযাপন করছি। আমার রাজ্য এখন ‘রাষ্ট্রহীন’। যে-কোনো সময় জীবন এবং সম্পত্তি ধ্বংস হতে পারে, যেমন লিবিয়া, লেবানন, নাইজেরিয়া, সিরিয়ার মতো দেশগুলোতে হয়।’
তিনি আরও বলেছেন, মনে হচ্ছে, যেন মণিপুরকে নিজের কৃতকর্মের ফল ভোগ করার জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কেউ কি শুনছেন? তার এই টুইটের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল ভেদ মালিক। তিনি মণিপুরের পরিস্থিতিকে দুঃখজনক বলে বর্ণনা করেছেন।
মণিপুরে চলমান জাতিগত সংঘাতে কেবল সাধারণ মানুষ নয়, রাজ্যের একমাত্র নারী মন্ত্রী, কুকি উপজাতীয় নেত্রী নেমচা কিগপেন এবং কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মেইতেই জনগোষ্ঠীর নেতা রাজকুমার রঞ্জন সিংহের বাড়িও ভস্মীভূত হয়েছে। হামলা চালানো হয়েছে রাজ্যের শাসক দল বিজেপির সভাপতি মায়ুম সারদা দেবীর বাড়িতেও। সরকারি সম্পত্তি ও কর্মকর্তাদের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বিজেপির প্রধান কার্যালয়ও। মণিপুরের ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহের মতে, এই সংঘর্ষের পেছনে মূল দায়ী মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে অনুপ্রবেশকারী কুকি জঙ্গিরা। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগের আঙুল তুলেছে মেইতেই সংগঠনগুলোও।
মণিপুরের পরিস্থিতির জন্য বিজেপির রাজনীতিকে দায়ী করে বিরোধী দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধী বলেছেন, মণিপুর যে জ্বলছে এবং প্রাণহানি হচ্ছে, তা থামাতে ব্যর্থতার দায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির। ভারতের প্রায় সাড়ে ৫০০ নাগরিক সংগঠন, শিক্ষাবিদ ও আইনজীবী এক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, বিজেপির ‘বিভাজনের রাজনীতিই’ মণিপুরে বর্তমান সহিংসতার সূচনা করেছে। প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এই সংকট নিয়ে জবাবদিহি করতে হবে এমন দাবিও করা হয় ওই যৌথ বিবৃতিতে। এদিকে গত ১৩ জুন কুকিদের বিরুদ্ধে মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলভিত্তিক ১৫টি মেইতেই সংগঠন জাতিসংঘেও অভিযোগ দায়ের করেছে। তাদের দাবি, কেন্দ্রীয় বিভিন্ন বাহিনী ‘কুকি সশস্ত্র তৎপরতা’ দমনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে না।
মণিপুরের চলমান জাতিগত সংঘাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি। তিনি বলেছেন, মানবিক কারণেই মণিপুরের পরিস্থিতি বেশ অস্বস্তিকর। চলমান এই সংঘাত থামাতে প্রয়োজনে ভারত সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
মার্কিন রাষ্ট্রদূতের এই বিবৃতির ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া না জানানো হলেও ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র মনিশ তিওয়ারি এক টুইটে লিখেছেন, ‘আমার চার দশকের রাজনৈতিক জীবনে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমেরিকার কোনো রাষ্ট্রদূতকে এভাবে মন্তব্য করতে দেখিনি। ভারতে নিযুক্ত নতুন মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একথা নিশ্চয়ই জানা আছে যে, আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যের মন্তব্য আমরা ভালোভাবে নিই না।’
মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে বেকায়দায় পড়ে গেছে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। বিগত অনেক বছর ধরে তারা কুকি সশস্ত্র দলগুলোর সঙ্গে অস্ত্রবিরতি মেনে চলছে। এখন দাঙ্গা দমনের নামে যদি সেই চুক্তি থেকে সরকার সরে যায়, তাহলে রাজ্যজুড়ে কুকিদের নতুন করে সশস্ত্র লড়াই শুরুর শঙ্কা আছে। সরকারের এই দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে কুকিরা। যে-কোনোভাবে আলাদা রাজ্যের দাবি আদায়ে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সে কারণেই কমছে না সংঘাত।
কুকিরা ১৯৬০ সাল থেকে একটা পৃথক রাজ্য দাবি করছে। ২০১০ সাল থেকে এই দাবিতে তারা নতুন করে সোচ্চার হয়েছে। পৃথক রাজ্য না হলে অন্তত মণিপুরের পাহাড়ি এলাকাগুলো তারা মিজোরামের সঙ্গে যুক্ত দেখতে চায়। অন্যদিকে, নাগারা বলছে, মণিপুরের পাহাড়ি এলাকাগুলো তাদের পূর্বপুরুষদের জায়গা। কুকিরা সেখানে যাযাবর হিসেবে এসেছিল। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত নাগাদের সঙ্গে কুকিদের বহু সংঘর্ষ হয়েছে। এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়, মেইতেই আর কুকিদের যে-বিবাদ এখন সবাইকে ভাবাচ্ছে, নতুন কোনো রাজ্য হলে সেখানে কুকিদের সঙ্গে নাগাদের একইরকম সংঘাত তৈরি হবে।
কয়েক বছর আগেও মণিপুরের সব জাতি-গোষ্ঠীর মানুষের একক দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু খ্রিস্টান মিশনারি ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক তৎপরতা যত বেড়েছে, মণিপুরের ধর্মীয় রাজনীতির হাওয়া তত বেশি জোরদার হয়েছে। দাঙ্গার শুরু থেকেই খ্রিস্টানদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করতে অগ্নিসংসংযোগ করা হচ্ছে চার্চগুলোতে।
মণিপুরের উত্তরের রাজ্য নাগাল্যান্ডে খ্রিস্টানদের সংখ্যা ৮৯ শতাংশ। দক্ষিণে মিজোরামে ৮৭ শতাংশ মানুষ খ্রিষ্টান। পশ্চিমে আসাম রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৬২ শতাংশই হিন্দু। প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমারের চিন প্রদেশের সঙ্গেও মণিপুরের সীমান্ত আছে। চিন প্রদেশের ৮৫ শতাংশ বাসিন্দাই খ্রিস্টান। মিজোরাম, নাগাল্যান্ডের বাইরে মেঘালয়, অরুণাচলেও এরইমধ্যে খ্রিস্টানরা সংখ্যায় প্রথম অবস্থানে চলে এসেছে।
এ-থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, মণিপুরকে ঘিরে খ্রিস্টানদের বড় একটা বলয় তৈরি হয়েছে। মণিপুরের কুকিরা এই রাজ্যের ৬০ ভাগ বা প্রায় ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে আলাদা রাজ্য গঠনের দাবি তুলেছে। তাদের এই দাবি বাস্তবায়িত হলে এটি যে খ্রিস্টান অধ্যুষিত একটি রাজ্য হবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি ও তাদের আদর্শিক গুরু সংগঠন আরএসএসের জন্য এটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। কেননা উত্তরপূর্ব-ভারতের সেভেন-সিস্টার্স নামে পরিচিত সাতটি রাজ্যের মধ্যে আসাম ও ত্রিপুরা ছাড়া অন্যগুলোতে খ্রিস্টানদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ফলে এই অঞ্চলে বিজেপি ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিস্তার ঘটানোর স্বপ্ন বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।