সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতিকে যে-ধারায় এগিয়ে নিতে চাচ্ছে, সে-ধারায় এগোচ্ছে না। বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন তারা; সব ষড়যন্ত্র বুমেরাং হয়ে সেনাবাহিনীকেই আঘাত করছে। পরিস্থিতি ঘুরেফিরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পক্ষেই আসছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে দেশটির শাসনভার ইমরানের কাঁধেই আসতে যাচ্ছে। দেশটিকে সমূহ বিপদ থেকে রক্ষার জন্য ইমরান খানের বিকল্প নেই- এমন ধারণা দিনদিন পোক্ত হচ্ছে।
পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ কিংবা দলটির প্রধান ইমরান খানকে রাজনীতি থেকে উৎখাত করাই এখন সেনাপ্রধানের প্রধান কাজ! এ-জন্য চেষ্টার ত্রুটি রাখছেন না জেনারেল আসিম মুনির। ইমরানকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের যে পাহাড় তৈরি হয়েছে, সবই এই জেনারেলের মদতে তৈরি। কেন তিনি এটা করছেন? কী চাচ্ছেন তিনি?
বিষয়টা দেশটির প্রতিটি নাগরিকের কাছে স্পষ্ট। তিনি দেশটির সাবেক অনেক সেনাপ্রধানের পথ ধরে হাঁটতে চাচ্ছেন। এই প্রচেষ্টায় তিনি আইয়ুব খান, জিয়াউল হক কিংবা পারভেজ মোশাররফের পথে পা বাড়িয়েছেন। কিন্তু এই বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে সেটা সম্ভব নয়। এখন পশ্চিমাবিশ^ বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির মূল উপাদান হচ্ছে গণতন্ত্র। তারা কোনো শাসককে পছন্দ না করলেও সেখানে গণতন্ত্রের মাধ্যমে পছন্দের লোককে ক্ষমতাসীন করে। এই অবস্থায় সাবেক সেনাশাসকদের মতো দেশ পরিচালনার কোনো পথ খোলা নেই। তাই, তিনি বিকল্প পথে দেশ শাসনের ভার নিজের কাঁধে রাখতে চাচ্ছেন। তার আকাক্সক্ষা- একটি পছন্দের সরকার বসিয়ে ডি-ফ্যাক্টো শাসক হওয়ার। এ-ক্ষেত্রে তার পছন্দ সদ্যবিদায়ী পিডিএম জোট। তিনি প্রচ্ছন্নভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে দেশে এনে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চান। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যুতে বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপের কারণে সেটা বাধাহীনভাবে সম্পন্ন করা আপাতত জেনারেল মুনিরের জন্য সম্ভব হচ্ছে না।
সেনাপ্রধানের মদতে গত বছরের এপ্রিলে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল। এ-কাজে নেপথ্যে কলকাঠি নেড়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার পক্ষে প্রত্যক্ষ অবস্থান নেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এই অবস্থান নিয়েছিল বলে ইমরান জনসমক্ষে অভিযোগ করেছেন। এমনকি, সেই ষড়যন্ত্রের একটি কূটনৈতিক নথিও তিনি সমাবেশে দেখিয়েছিলেন।
এরপর ইমরান খানের বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক মামলা হয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি আদালতে ওঠা মামলাগুলোতে তিনি বিচার বিভাগের সহায়তা পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আনা বেশ কয়েকটি মামলা উচ্চআদালত খারিজ করেছেন। তাছাড়া, তোশাখানা মামলায় নিম্নআদালতের কারাদণ্ডের রায় স্থগিত করেছেন উচ্চআদালত। মে মাসে হাইকোর্ট প্রাঙ্গন থেকে গ্রেফতারের পর মুক্তির নির্দেশসহ বেশ কিছু ইস্যুতে তিনি উচ্চ কিংবা সর্বোচ্চ আদালতের সুবিচার পেয়েছেন। সেনাপ্রধান, শেহবাজ শরিফ ও আসিফ আলি জারদারির সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখলেও বর্তমান প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসাকে মৌলিকভাবে সেনা এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী মনে করা হয়। শেষ পর্যন্ত তার হাত ধরেও ইমরান খান সুবিচার পেতে পারেন বলে অনেকেই মনে করছেন।
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে পিলো-পাসিং গেম তৈরি হয়েছে দেশটিতে। প্রেসিডেন্টের চাওয়ার বিপক্ষে গিয়ে সেনাপ্রধানের মদতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচনের তারিখ পেছানোর সব ধরনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। নির্বাচনের তারিখ পেছানো হলে সেনাপ্রধানের লাভ কী? লাভটা স্পষ্ট। সেনাপ্রধান দৃশ্যত নির্বাচনের তারিখ ঘোষণায় গড়িমসি করে সময়টাকে টেনে বড় করতে চাচ্ছেন। এর পেছনে দুটি বিষয় কাজ করছে। একটি হলো- ইমরান খানের আকাশচুম্বি জনসমর্থন। এখন নির্বাচন হলে নওয়াজ শরিফের মতো ঘোষিত দুর্নীতিবাজকে মানুষ ভোট দেবে না। তিনি সময় ক্ষেপণ করে ইমরান-বিষয়ক উন্মাদনাকে প্রশমিত করার আপাত লক্ষ্য হাতে নিয়েছেন। কারণ, ইমরানের জনপ্রিয়তার অবস্থা এখন এমন যে, তিনি যদি একেবারে অপরিচিত কোনো প্রার্থীকেও যে কোনো প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অবতীর্ণ করেন, তিনিই জয়ী হয়ে আসবেন। আরেকটি বিষয় হলো- সেনাপ্রধান চাচ্ছেন, জনশুমারির ভিত্তিতে আসন বিন্যাসের মতো একটি অনির্দিষ্ট বিষয়কে সামনে রেখে সময় বাড়াতে বাড়াতে এটিকে বছর, দুইবছর করে অতীতের সেনাশাসকদের মতো সময়টাকে প্রলম্বিত করবেন।
সেনাপ্রধানের এই চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, দেশটির প্রেসিডেন্ট ড. আরিফ আলভি ইমরানের দল পিটিআই-র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি ইমরানের ঘনিষ্ঠ। এরইমধ্যে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তরের ৯০ দিনের বাধ্যবাধকতা মাথায় রেখে ৮৯তম দিনে, অর্থাৎ আগামী ৬ নভেম্বর ভোটগ্রহণের জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তাব দিয়েছেন। এই তারিখকে সামনে রেখে তফসিল ঘোষণার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার সিকান্দার সুলতান রাজাকে চিঠিও দিয়েছেন। সিইসি রাষ্ট্রপতির প্রস্তাব অমান্য করে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করছেন। তিনি আগামী বছর জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ভোটগ্রহণ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছেন। এখন প্রেসিডেন্ট কী পদক্ষেপ নেবেন, সেটা দেখার বিষয়। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদাধিকারীকে উপেক্ষা করে সেনাপ্রধান সফল হবেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না।
একটি রায় ইমরান খানের জন্য দারুণ সুবিধা তৈরি করে দিয়েছে। সদ্যবিদায়ী প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালের নেতৃত্বাধীন একটি বেঞ্চের দেওয়া রায়ে বিপাকে পড়েছেন প্রভাবশালী দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকরা। যাদেরকে আগামী নির্বাচনে ইমরান খানের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বলে মনে করা হচ্ছে। এই রায়ে শেহবাজের নেতৃত্বাধীন পিডিএম জোট সরকারের পাস করা দুর্নীতিবিরোধী আইনের সংশোধনী বাতিল করে দিয়েছেন আদালত। আর এই রায় কার্যকর হওয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি, সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ, ইউসুফ রাজা গিলানিসহ অনেকেই তদন্তের মুখে পড়ছেন। আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী কার্যকলাপ তদারককারী সংস্থা ন্যাবের কার্যপরিধির ওপর লাগাম পরানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ন্যাব শুধু ৫০ কোটির নিচের দুর্নীতিমূলক অপরাধ তদন্ত করতে পারবে।
এখন রায় অনুযায়ী, ন্যাবের কার্যপরিধি সংকীর্ণ করে ফেলার পর যেসব মামলা তুলে নেওয়া হয়েছিল, তা আবার চালু হতে হচ্ছে। শেহবাজ শরিফ, তার ছেলে হামজা, সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খাজা সাদ রফিকসহ ১১৫টি রেফারেন্স নিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে ন্যাব। রেফারেন্সগুলোর কার্যক্রম শুরুর পর লন্ডনে পালিয়েছেন নওয়াজ শরিফের মেয়ে মরিয়ম নওয়াজ। ভাইয়ের সঙ্গে জরুরি কথা আছে বলে শেহবাজ শরিফও পালিয়েছেন। দৃশ্যত, সেনাপ্রধানে ষড়যন্ত্র এখানে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করেছিলেন ইমরান খান। এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের সুবাদে ইমরানের আরও প্রতিদ্বন্দ্বী ধীরে ধীরে সটকে পড়তে পারেন। এতে বিশাল সুবিধা আসবে ইমরানের ঘরে।
পাকিস্তানের বর্তমান যে অর্থনীতি, তা সেনাপ্রধান কিংবা তাদের সমর্থিত কোনো পুতুল সরকার এসে সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। এখন দেশটির ফরেন রিজার্ভ ১৩ বিলিয়ন ডলারের মতো। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের নাভিশ^াস উঠেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ হচ্ছে। এই অবস্থায় জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করা ইমরান খান মানুষের হৃদয়ে আরও শক্ত করে স্থান করে নিচ্ছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ধীরে ধীরে মানুষ সেনাবাহিনীর বুলেটের মুখে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এই অর্থনৈতিক দুরবস্থা মানুষকে যদি মাঠে নামতে বাধ্য করে, সেনা-ষড়যন্ত্র নিমিষেই ভেঙে চুরমার হতে পারে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন।
এ-ক্ষেত্রে ইমরানের সবচেয়ে বড় শক্তি হলেন তরুণরা। দেশের প্রায় অর্ধেক ভোটারই তরুণ। তাদের কাছে ইমরান খান আদর্শ রাজনীতিক। ইমরানের অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, সততা, স্পষ্টবাদিতা এবং প্রধানমন্ত্রিত্বকালীন সাফল্য তো বটেই, তার অতীতও তাকে তরুণদের মনে অন্যরকম আসনে বসিয়েছে। বিশেষ করে তার ক্রিকেট তারকার তকমা তাকে তরুণদের মনে স্থায়ী আসন তৈরি করে দিয়েছে। অন্যদিকে, দুর্নীতি, বিরোধী দমন কিংবা সেনা-তোষণের কারণে দেশটির রাজনীতিতে নওয়াজ কিংবা ভুট্টো পরিবারের গ্রহণযোগ্যতা কমতে কমতে শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তাদের বদলে পাকিস্তানের ত্রাতা হিসেবে তরুণদের কাছে ইমরানই একমাত্র ভরসা।
তরুণরা যদি মাঠে নেমে পড়ে, সেনা এস্টাবলিশমেন্ট কোনোভাবেই তাদের রুখতে পারবে বলে মনে হয় না। নিকট অতীতে সেই উদাহরণ দেখেছে দেশটি। মে মাসে ইমরানকে গ্রেফতারের পর সারাদেশ অগ্নিগর্ভ হয়েছিল। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সেনা স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও ভাংচুর হয়। একাত্তরের পর প্রথমবারের মতো সেনা ও জনতা মুখোমুখি দাঁড়ায়। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, এই অবস্থা যে কোনো সময় তৈরি হতে পারে।
ইমরান খান ও তার দল বহুবিধ চাপের মধ্যে থাকলেও আপসহীনতার নীতি থেকে তিনি নড়ছেন না। সততাকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষতিকর উপাদানগুলোর সঙ্গে অন্যায্য মধ্যস্থতায় যেতে রাজি নন তিনি। কারাগারে দেখা করতে যাওয়া আইনজীবীদের মাধ্যমে তিনি যে বার্তা পাঠাচ্ছেন, তা হলো- অন্যায়ের সঙ্গে কোনো আপস নয় এবং প্রয়োজনে জনগণকে মাঠে নামতে হবে।
ষড়যন্ত্রের শেষ নেই। একটার পর একটা পদক্ষেপ নিয়ে ইমরান ও তার দলকে নিস্ক্রিয় করার চেষ্টা করছেন সেনা-সমর্থিন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন। কিন্তু কোনো পদক্ষেপই তেমন সফল হচ্ছে না। কোথাও না কোথাও এসে সেইসব ষড়যন্ত্র বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটিই নিয়ম; অন্যায্য কোনো কিছু ভালোভাবে এগোয় না। বাধাপ্রাপ্ত হতে হতে একসময় তা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। ইতিহাস এটিই বলে। সেই ইতিহাসের পাতায় ভর করে ইমরান আবার পাকিস্তানের ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হবেন- এটিই জনগণের চাওয়া।