স্রোতে গা এলিয়ে দেওয়ার জন্য অনেকেই থাকেন। কিন্তু, স্রোতের বিপরীতে, প্রভাবশালী প্রতিবেশী একটি দেশের বিরুদ্ধে শির উঁচু করে কথা বলা চাট্টিখানি কথা নয়। তিনি প্রভাবশালীদের চোখ-রাঙানিকে যে তোয়াক্কা করেননি, তা শুধু নয়, তাদের বিরুদ্ধে এমন প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন, তাকে নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি। বলছি, মোহাম্মদ মুইজ্জুর কথা।
ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন বিরোধী দল প্রোগ্রেসিভ পার্টি অব মালদ্বীভস বা পিপিএম প্রার্থী ড. মোহামেদ মুইজ্জু।
যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ব্যাচেলর্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি সম্পন্ন করা এবং ইউনিভার্সিটি অব লিডস থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর পিএইচডি করা মুইজ্জুর হাতে উঠেছে দীর্ঘকাল মুসলিম শাসনের অধীনে থাকা মালদ্বীপের শাসনভার।
দ্বাদশ শতকে মালদ্বীপে শুরু হয় মুসলিম শাসন। ১১৫৩ থেকে ১৯৫৩ সাল- এই ৮০০ বছর ৯২ জন সুলতান নিরবিচ্ছিন্নভাবে শাসন করেন দ্বীপটি। তখন মুসলিমরা ওই দ্বীপে মুসলিম সংস্কৃতিকে শক্তভাবে প্রোথিত করেন। যেহেতু মালদ্বীপে আট শতাব্দী ধরে ইসলামি সালতানাত ছিল, স্বভাবতই এই অঞ্চলের বর্তমান সংস্কৃতিও ইসলাম-প্রভাবাধীন। দেশটির ১০০ ভাগ নাগরিক মুসলিম।
মালদ্বীপে বর্তমানে রাষ্ট্রপতি-শাসিত সরকারব্যবস্থা। প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন সরকারপ্রধান। প্রেসিডেন্টই ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের নিয়োগ দেন। প্রেসিডেন্ট পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তবে মুসলিম না হলে দেশটিতে নাগরিকত্ব পাওয়া যায় না; অমুসলিমদের কোনো ভোটাধিকার নেই। সেখানে ৫০ সদস্যের একটি মজলিসে সুরা আছে; তারা পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এই ৫০ সদস্যের মধ্যে আটজনকে মনোনীত করেন প্রেসিডেন্ট। এই একটি উপায়েই নারীরা পার্লামেন্টে প্রবেশের সুযোগ পান। না হয়, মালদ্বীপ ঐতিহাসিকভাবে পুরুষ-শাসিত একটি অঞ্চল। অনেক ইতিহাসবিদ দাবি করেন, ‘মালদ্বীপ’ অর্থ হচ্ছে ‘মেল দ্বীপ রাজ’ বা পুরুষশাসিত রাজ্য।
অর্থনীতিকে বাদ দিলে সমাজের সব অনুষঙ্গ ইসলামি সংস্কৃতি দিয়েই শোভিত। তারা সুন্নি মুসলিম। যে-দল থেকে মুইজ্জু নির্বাচিত হয়েছেন, সেই পিপিএম-ও ইসলামপন্থী দল। দলটির আদর্শ হচ্ছে- ইসলামপন্থা, সামাজিক রক্ষণশীলতা এবং মালদ্বীপ জাতীয়তাবাদ। রাজনৈতিক অবস্থান ডানপন্থা।
নির্বাচনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট মালদ্বীভিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এমডিপি নেতা ইব্রাহিম মোহাম্মদ সোলিহ। দলটির মূলনীতিও ইসলাম। তবে মুইজ্জুর দলের তুলনায় তারা উদারপন্থী। দলটির আদর্শ- উদার রক্ষণশীলতা, ইসলামি গণতন্ত্র, পরিবেশবাদ এবং ইকনোমিক লিবারেলিজম। তাদের রাজনৈতিক অবস্থান মধ্যডান।
ধর্মীয়ভাবে কট্টর মুইজ্জু অর্থনীতিতে চীনঘেঁষা হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। নির্বাচনে শক্তিশালী প্রতিবেশী এবং ঐতিহাসিকভাবে দেশটির নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগী ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন তিনি। ‘ভারত খেদাও’ স্লোগান নিয়ে নির্বাচনি প্রচারকাজ চালিয়েছেন তিনি। মুইজ্জু প্রতিশ্রুতি ছিল, নির্বাচিত হলে দেশটি থেকে ভারতীয় সেনা উপস্থিতির অবসান ঘটাবেন। নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পরও সেই প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন, মালদ্বীপের মানুষ চায় না, এ-দেশে ভারতীয় সেনা অবস্থান করুক।
মালদ্বীপের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ৬১ বছর বয়সী সোলিহ ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তার নির্বাচনি প্রচারকাজের স্লোগান ছিল ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’।
মালদ্বীপ হচ্ছে দ্বীপের মালা। ভারত মহাসাগরে নীল জলরাশির ১ হাজার ২০০টির মতো ছোট-বড় দ্বীপ নিয়ে এই দেশ। অপরূপ সৌন্দর্যের সমুদ্রসৈকত আর বিলাসবহুল রিসোর্টের জন্য দেশটি সুপরিচিত। ছোট দ্বীপগুলো বিশে^র ধনী ও খ্যাতনামা ব্যক্তিদের অবকাশযাপনের ঠিকানা।
একজন নিসর্গপ্রেমীর আয়নায় দেশটির আকর্ষণীয় ছবি ফুটে উঠবে সন্দেহ নেই, কিন্তু পর্যবেক্ষকের অনুসন্ধানী চোখে এর চেহারা কিছুটা অন্যরকম। দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা দিন দিন কদর্য চেহারা নিচ্ছে। এই হস্তক্ষেপের অভিঘাতে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এক যুগের বেশি সময় ধরে টালমাটাল। মালদ্বীপে বেশির সময়ই ক্ষমতায় ছিল ভারতপন্থী সরকার। চীনপন্থী সরকার এবার-সহ ক্ষমতায় এলো তিনবার।
চীন-ভারতের পাশাপাশি এখানে আরেকটি দেশের প্রভাবও আছে, তা হলো যুক্তরাষ্ট্র। ভারত মহাসাগরে মালদ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থান এবং যুক্তরাষ্ট্রের নৌ ও সামরিক ঘাঁটি থাকা ডিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপ থেকে এর নৈকট্যের কারণে ক্ষুদ্র এই দেশটিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক কিছু। মালদ্বীপের কৌশলগত গুরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়ে ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটা ছিল ভারতের বাইরে কোনো দেশের সঙ্গে মালদ্বীপের প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি। তবে, এই নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ভূমিকা দেখা যায়নি।
সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে স্থানীয় দুই মোড়ল চীন ও ভারতের মধ্যে মধ্যে কে জয়ী হবে- তা দেখতে শতকোটি মানুষের নজর ছিল এই নির্বাচনের দিকে। প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের প্রভাব যে আরও খাটো হয়ে এলো, নির্বাচনে সেটি স্পষ্ট হয়েছে। ভারতকে এই লজ্জা দেওয়ার মিশনে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছিলেন ৪৫ বছর বয়সী মুইজ্জু।
মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতের পুরনো আর্থিক ও নিরাপত্তা সম্পর্ক রয়েছে। তবে, চীন সম্প্রতি দেশটির অবকাঠামো খাতে বিপুল বিনিয়োগ করছে। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় পরিবহন ও জ্বালানি নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে এই বিনিয়োগ করছে বেইজিং।
কিন্তু সংকটের সময় প্রথম সহায়তাকারী হিসেবে ভারতকে তুলে ধরেছিলেন সোলিহ। অপরদিকে মুইজ্জু বলেছিলেন, ভারতের প্রভাব মালদ্বীপের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি। তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমান প্রেসিডেন্টের হাত ধরে মালদ্বীপে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতির পরিকল্পনা করছে নয়াদিল্লি।
মুইজ্জু প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ১৭ নভেম্বর। বর্তমানে তিনি মালদ্বীপের রাজধানী মালের মেয়র। ২০১২ সালে তার রাজনৈতিক কর্মজীবন শুরু। আধালাথ পার্টি বা এপি-র সদস্য হিসেবে প্রেসিডেন্ট ওয়াহিদের প্রশাসনে তিনি গৃহায়ন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। ২০১৩ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পর তিনি প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের প্রশাসনের অধীনে মন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। পরে এই মন্ত্রণালয়ের নাম হয় গৃহায়ন ও অবকাঠামো মন্ত্রণালয়। তিনি ওই মন্ত্রণালয়ের প্রধান ছিলেন। ২০১৮ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইব্রাহিম সোলিহ। এরপর দুর্নীতির অভিযোগ এনে ইয়ামিনকে কারাগারে পাঠানো হয়। তার অনুপস্থিতিতে দলের হাল ধরেন মুইজ্জু।
কিছু গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো মুইজ্জুকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। এর মধ্যে রয়েছে সিনামালে ব্রিজ। এই অসাধারণ সেতুটি রাজধানী মালে-কে ভেলানা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে। ২০ কোটি ডলার ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। এরপর হুলহুমালে হয়ে ওঠে গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর। ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত তার অনেক অবকাঠামো-উদ্যোগ সফলভাবে সম্পন্ন হয়। এরমধ্যে রয়েছে অসংখ্য পোতাশ্রয়, জেটি, পার্ক, সরকারি ভবন, মসজিদ, খেলার মাঠ ও সড়ক।
শুধু মন্ত্রী থাকাকালেই চীনের সঙ্গে কাজ করেননি মুইজ্জু। এরপরও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছেন। গত বছর চীনের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশ নেন তিনি। এ-সময় মুইজ্জু বলেন, ‘দল ক্ষমতায় এলে আমাদের দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।’
মালদ্বীপের রাজধানী মালে থেকে নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেছেন আলজাজিরার প্রতিবেদক টনি চেং। তিনি বলেন, নির্বাচনি প্রচারের সময় দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা মুইজ্জুর পক্ষে সহজ হবে কিনা, তা সময়ই বলবে। তবে, মালদ্বীপের অর্থ, বাণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়নের সঙ্গে ভারত গভীরভাবে জড়িত।
কেন মালদ্বীপের মানুষ ভারতের প্রতি অসন্তুষ্ট, তারও ব্যাখ্যা দিয়েছে আলজাজিরা। বলা হয়েছে, ভারতের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব দ্বীপরাষ্ট্রটির বেশির ভাগ মানুষ পছন্দ করেন না। আর এই সুযোগে ভারতবিরোধী প্রচারণা চালিয়ে নির্বাচনে সফল হয়েছেন মুইজ্জু। বিশ্লেষকরা বলছেন, ১০০ শতাংশ মুসলিমের দেশে ভারতের এই প্রভাবের কারণে অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। নির্বাচনে এর ফলাফল দেখা গেছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল- কট্টর হিন্দুত্ববাদী সরকারি দল বিজেপি-র নেতাকর্মীদের হাতে প্রশাসনের প্রশ্রয়ে ভারতে মুসলিমদের নিগৃহীত হওয়ার বিষয়।
অভিযোগ রয়েছে, ভারতের হস্তক্ষেপে ২০১৮ সালে আবদুল্লাহ ইয়ামিনকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসেন ইব্রাহিম সোলিহ। ক্ষমতায় আসার পর ইয়ামিনকে কারাগারে পাঠান তিনি। মুইজ্জু প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে ইয়ামিনকে মুক্ত করবেন। দেশটির মানুষের কাছে স্পষ্ট, ইয়ামিনকে কারান্তরীণ রাখার পেছনে ভারতের হাত রয়েছে। কারণ, ইয়ামিন ছিলেন চীনঘেঁষা। তিনি মালদ্বীপে নির্মাণ প্রকল্পের জন্য ভারতকে প্রত্যাখ্যান করে চীনের কাছ থেকে প্রচুর সহায়তা নিয়েছিলেন। নির্বাচনে জনতা মুইজ্জুর স্লোগান ধারণ করে ভারতকে সেই জবাব দিয়েছে।
শত বছরের মুসলিম ঐতিহ্য ও শতভাগ মুসলিমের দেশ মালদ্বীপ। সেই দেশের ইসলামপন্থী দল পিপিএম থেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রক্ষণশীল মুসলিম মোহাম্মদ মুইজ্জু। শুধু অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতকে বর্জনের ডাক দিলেও তার মজ্জাগত ভারত-বিরোধিতা এই নির্বাচনে প্রতিফলিত হয়েছে। সামনে তার কঠোর অবস্থান আঞ্চলিক রাজনীতিতে ভারতকে আরও কোণঠাসা করতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।