দ্রুত বদলে যাচ্ছে এ অঞ্চলের ভূকৌশলগত সর্ম্পক। দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়ছে চীনের প্রভাব। এর ফলে ভারতের সাথে বৈরিতা তীব্ররুপ নিচ্ছে। চীন ও ভারতের বৈরিতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দর কষাকষিতে সুবিধা পেতে দুটি বৃহৎ দেশের সঙ্গেই ভারসাম্যমহৃলক সর্ম্পক রাখতে হবে ঢাকাকে।
প্রচলিত ধারণা আছে যে বৃহৎ শক্তির বৈরিতায় ক্ষুদ্র প্রতিবেশিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রবাদ আছে, রাজায় রাজায় ঝগড়া হয় উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। এমন পরিস্থিতি এড়াতে প্রয়োজন ভারসাম্যমুলক ও কৌশলী পদক্ষেপ। যেখানে শুধু গুরুত্ব পাবে ক্ষুদ্র দেশটির স্বার্থ। চীন ও ভারতের মতো বড় দুটি দেশের বৈরিতায় বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে। বলা যায় কিছুটা হচ্ছেও।
বঙ্গোপসাগরের তীরে কৌশলগতভাবে গুরুপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটির অধিক। উদীয়মান অর্থনীতির দেশটি একটি আকর্ষণীয় বাজারও বটে। ফলে আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশের গুরুত্ব ব্যাপক। চীন ও ভারতের বৈরিতার সুযোগ লাগিয়ে বাংলাদেশ বিদেশি বিনিয়োগ পেতে পারে।
ভারত বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের মিত্র। স্বাধীনতার পর থেকে টানা ৪০ বছর বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল ভারত। সে তুলনায় চীনের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন কমই ছিল। তবে গত দুই দশকে এই চিত্র পাল্টে গেছে। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো চীন ভারতকে হটিয়ে বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারে পরিণত হয়। বাংলাদেশ বর্তমানে মোট আমদানির ৩৪ ভাগই আসে চীন থেকে। বর্তমানে চীন থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ১৪ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আর রফতানি করে ১ বিলিয়ন ডলারের কম।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগদানের পর থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ছেই। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় এদেশে ২৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি হয়। এটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের পরিমাণ দাড়াবে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। এটা একক কোনো দেশের বাংলাদেশে বৃহত্তম বিনিয়োগের অঙ্গীকার।
চীনের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগে কোণঠাসা হয়ে পড়ার আশংকায় ২০১৭ সালে ভারতও এদেশে ৫ বিলিয়ন ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এটাই ভারতের বৃহত্তম অর্থলগ্নী এদেশে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতের বিনিয়োগ প্রকল্পগুলোতে এতো বেশি শর্তারোপ করা হয় অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এ অর্থ ব্যবহার করতে পারে না। এছাড়া এসব বিনিয়োগের প্রধান লক্ষ থাকে ভারতের দুই অঞ্চলের মধ্যে কানেকটিভিটি সহজ করা। এরপরও বাংলাদেশের দরকার ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগ। আর চীন ও ভারত চাচ্ছে বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রভাব বাড়াতে। যা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ। আসুন আমরা দেখে নেই দুদেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি কেমন।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমরাস্ত্র সরবরাহকারী দেশ চীন। চীন যত সমরাস্ত্র রফতানি করে তার ২০ ভাগই কেনে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে উপরে আছে শুধু পাকিস্তান। এদেশে মেরিটাইম পেট্রাল ভেসেল, সাবমেরিন, জঙ্গিবিমান, ট্যাংক, জাহাজ বিধ্বংসী ও ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করে থাকে চীন। এক্ষেত্রে ভারত পেছনে পড়ে রয়েছে। তাই সম্প্রতি এদেশে অস্ত্র বিক্রিতেও মরিয়া হয়ে উঠেছে নয়াদিল্লি।
বাংলাদেশের অনেক নিশেষজ্ঞ মনে করেন চীনের কাছ থেকেই বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হতে পারে। লাদাখে চীনা সেনাদের হামলায় ভারতের শতাধিক সেনা হতাহত হওয়ার পরপরই চীন বাংলাদেশে তিন হাজারের বেশি বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। করোনারভাইরাস মহামারির এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের জন্য এটা দারুণ সুখবরর। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজারে এখন সব মিলিয়ে ৮২৫৬টি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাবে।
তাছাড়া চীনে শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য যুদ্ধের ফলে চীনা কোম্পানির বাংলাদেশে স্থানান্তরের সুযোগ তৈরি হয়েছে। চীনে এখন বেতন বেড়েই চলেছে। চীনের বেইজিং, সাংহাই, গুয়াংডং, জেজিয়াংসহ অনেক এলাকায় নুন্যতম মাসিক বেতন ৩০০ ডলার বা ২৫ হাজার টাকার বেশি। আর বাংলাদেশে এটা ১০০ ডলার বা আট হাজার টাকার মত। মানে চীনের এক তৃতীয়াংশ। ভিয়েতনামেও নুন্যতম বেতন ২০০ ডলার।
ফলে চীনে পণ্য উৎপাদন ব্যয়বহুল হয়ে পড়েছে। ফলে চীনা উদ্যোক্তারা এখন অন্য দেশে কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করছেন। তাদের অগ্রাধিকার তালিকায় আছে এমন দেশ যেখান থেকে শুল্কমুক্ত সুবিধায় চীনসহ বিভিন্ন দেশে পন্য রফতানি করা যায়। এক্ষেত্রে তাদের পছন্দের তালিকায় আছে বাংলাদেশ। যেমন সনি মোবাইল ও স্যামসাংয়ে মত কোম্পানি চীন থেকে সরে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞার বলছেন, চীনাদের বিনিয়োগ পেতে হলে দ্রæত তাদের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণ শেষ করতে হবে। শুধু পোশাক রফতানি নির্ভরতা কাটিয়ে পণ্য বহুমুখীকরণ করতে হবে। তাহলেই চীনের শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানো যাবে।
বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বা বেপজার সূত্রে বাংলাদেশের গনমাধ্যমে বলা হয়েছে, গত দুই বছর ধরে অনেক চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য আলোচনা চালাচ্ছে। চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে চীনের একটি বৃহৎ কেমিকেল কোম্পানিকে ১০০ একর জায়গা দেওয়া হয়েছে। আরও বহু কোম্পানি পাইপলাইনে আছে।বাংলাদেশ সরকার ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেও কাজ খুব ধীরগতিতে এগুচ্ছে।
বর্তমানে চীন বাংলাদেশে পদ্মা সেতু, পায়রা বন্দর নির্মাণসহ নানা অবকাঠামো প্রকল্পের সাথে জড়িত। এছাড়াও চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, চট্টগ্রাম এবং খুলনায় দুটি বড় তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের সাথেও চীন সম্পৃক্ত আছে। চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সর্বাধুনিক নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে শাহজালাল সার কারখানা ও বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্র। পরিবহন, বিদ্যুত, জ্বালানি ও টেলিযোগাযোগসহ নানা ক্ষেত্রে চীনের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো জড়িত আছে। চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক প্রথম দফায় যেসব প্রকল্পে ঋণ দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বিদ্যুত বিতরণব্যবস্থা উন্নয়ন প্রকল্পও রয়েছে।
চীনের আরেকটি বড় বিনিয়োগের আগ্রহ ছিলো সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মান। নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারতের আপত্তিতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্প বাতিল করা হয়েছে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন চীন-ভারত কোনো বলয়ে জড়িয়ে পড়া বাংলাদেশের ঠিক হবে না। চীন তার নিজস্ব বলয় তৈরি করছে, ভারতের সঙ্গে যুক্ত হবে আমেরিকা। বাংলাদেশের চেষ্টা থাকা উচিত এই দুই বলয়ের বাইরে থাকা। লাদাখের ঘটনা প্রমাণ করে, ভারত-চীনের এই উত্তেজনা ও সংঘর্ষ সহজে থামবে না। এমন উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চেষ্টা থাকা উচিত কারও মুখোমুখি না হওয়া, নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। বাংলাদেশের জন্য বড় শিক্ষা হচ্ছে মিয়ানমার ইস্যুতে চীন-ভারতের কেউই বাংলাদেশের পাশে থাকেনি।
নিরাপত্তা বিশ্নেষক ও অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমডোর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী সমকালে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ভারত ও চীন উভয় দেশই আমাদের অর্থনৈতিক অংশীদার। তারা আমাদের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে অনেক অর্থ বিনিয়োগ করে থাকে। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু নেতিবাচক দিক আছে। যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের সমর্থন না থাকা, অব্যাহত সীমান্ত হত্যা, অভিন্ন নদীর ন্যায় সঙ্গত হিস্যা না হওয়া, এনআরসি ইস্যু এবং তথাকথিত অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশি বলে চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
ইশফাক চৌধুরী লিখেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় এসে 'নেইবারহুড ফার্স্ট' স্লোগান দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনও আমাদের হতাশ করেছে; প্রকৃতপক্ষে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে চীনা ভেটো মিয়ানমারের পরিকল্পিত গণহত্যাকে আরও উস্কে দিয়েছে। সুসম্পর্ক সত্ত্বেও কিছু বিষয়ে দুই দেশই আমাদের হতাশ করেছে।
চীন ও ভারতের মধ্যে বৈরিতা বাড়ার ফলে দুটি দেশ চাইবে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশকে তাদের বলয়ের মধ্যে রাখতে। তবে বাংলাদেশকে মনে রাখতে হবে যে তারা প্রত্যেকেই তাদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে। তাই বাংলাদেশকে কৌশলে এগুতে হবে। কারও প্রতি বিশেষ দুর্বলতা দেখানো ঠিক হবে না। দুই দেশের বৈরিতার সুযোগ নিতে হলেও উভয়ের প্রতিই ভারসাম্যপূর্ন সর্ম্পক বজায় রাখতে হবে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সর্ম্পক যেমন দীর্ঘকালের তেমনি চীনের সঙ্গেও আমাদের রয়েছে ঐতিহাসিক সর্ম্পক। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরের আগে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এক নিবন্ধে লিখেছেন, চীন ও বাংলাদেশের জনগণ প্রাচীনকাল থেকেই পরস্পরের ভালো প্রতিবেশী ও বন্ধু। প্রাচীনকালের সিল্করুট ছিল দু'পক্ষের যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার মূল মাধ্যম।
চীনের ফাহিয়েন ও হিউয়েন সাং বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের সন্ধানে এ অঞ্চলে এসেছিলেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের অতীশ দীপঙ্কর চীনে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার করেছেন। চীনের মিং রাজবংশ আমলের সমুদ্রচারী চাং হো'ও দু'বার বাংলা সফর করেন। বঙ্গদেশের তৎকালীন রাজা চীনের মিং রাজবংশ আমলের সম্রাটকে একটি জিরাফ উপহার দিয়েছিলেন। তখন ওই জিরাফ চীনে 'চীনা ড্রাগন ছিলিন' নামে খ্যাতি অর্জন করেছিল।
জিনপিং লিখেছেন, চীন-বাংলাদেশ মৈত্রীর ইতিহাসও দীর্ঘ। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই দু'বার ঢাকা সফর করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও সেসময় দু'বার চীন সফর করেন। জিনপিং লিখেছেন, আমরা মৈত্রীর সেতু শক্তিশালি করবো; পরস্পরকে বোঝা ও ভালোবাসার সুফল অর্জন করবো। চীন ও বাংলাদেশের জনগণ একসাথে ইয়া লু জান বু চিয়াং নদী তথা যমুনা নদীর পানি খায়। দু'দেশের বন্ধুত্ব সুদীর্ঘকালের।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে
লাদাখ নিয়ে তথ্যবহুল একটি ভিডিও দেখুন